-এস এম,মোফাজ্জল হোসেন
সে অনেক অনেক দিন আগের কথা,শীতকাল এলেই গ্রামে গ্রামে শুরু হতো পালা গান,জারী সারী গান,ধোয়া গান,গাদম খেলা,ডাংগুলি খেলা, লাঠি বারী খেলা,নাটক মন্চায়ন, যাত্রা পালা,অরো অনেক কিছু।আমাদের গ্রামের প্রায়াত আমীর হোসেন তালুকদারছিলেন নাটকের পরিচালক।
দুই মাস তিন মাস ব্যাপী নাটকের মহড়া চলতো আমাদের বানিয়াজান স্কুল মাঠে ।আমরা রাতকিছুটা হলেই পরিচালকের নির্দেশে স্কুল মাঠের বড় আমতলায় একে একে সবাই হাজির হতাম। তখনতো ইলেক্টিসিটি ছিলো না,টিভি তো প্রশ্নই আসে না,কিছু কিছু বাড়ীতে রেডিও ছিলো,আমাদের বাড়ীতে একটা নাগমা রেডিও ছিলো।
যা হোক, নাটকের মহড়া শুরু করার আগেই হ্যাজাক বাতী জালানো হতো এবং পরিচালক সাহেব সব অভিনেতা ছেলে অভিনেত্রী উপস্হিত আছে কিনা দেখে নিতেন।এখানে একটি বিষয় পরিস্কার করা দরকার,তা হলো তখনকার দিনে মেয়ে আর্টিস দিয়ে নাটকের মহড়া করা অসম্ভব ব্যাপার ছিলো।মেয়েলী চেহারার সুন্দর সুন্দর ছেলে সংগ্রহ করে অভিনয় শেখানো হতো।
একটি নাটক তৈরী করতে অনেক শ্রম ঘাম ,পরিচালকের বকাঝকা, মাঝে মাঝে হালকা জরিমানা দিতে হতো, আহার নিদ্রা ,ঘুম, লেখাপড়া , তার উপর বাবা মায়ের অভিশাপ উপেক্ষা করে দিনে পর দিন ,রাতের পর রাত এবং দুই তিন মাস পরে নাটকটি আলোর মুখ দেখতো,এলাকায়ও উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করতো।
নাটক তৈরীহয়ে গেলে এলাকার হাট বাজার গুলোতে ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হতো, আগামী রবিবার বানিয়াজান স্কুল মাঠে রাত নয়টায় আমির হোসেন তালুকদারের নির্দেশনায় আলোমতি নাটক মন্চায়ন হবে,আপনারা সবাই আমন্ত্রীত। প্রতিটি বাজারেই জোরেসরে প্রচার করা হতো ।
নাটকের দিন,সারাএলাকায় সাজ সাজ রব উঠতো নাটক দেখার জন্য, আমরা এলাকা থেকে বাস, চকি, ত্রিফল সংগ্রহ করে স্কুলের মাঠেনাটকের মন্চ পরিচাকের নির্দেশে বেলা ডোবার আগেই তৈরী করে ফেলতাম ।
মাঠের চারিধারে সকাল থেকেই গ্রামীন দোকানীরা দোকান সাজাতো।আহাঃ, কিযে আনন্দ, কি যে ফুরতি, এখন কাউকে তা বুঝাতে পারবো না।ধনবাড়ী থেকে পরিমল মেকাপ ম্যান বেলা ডোবার কিছুক্ষন পরই সাজঘরে বসে বসে বিড়ি টানতো । ধনবাড়ী সাজ ঘড় থেকে অভিনয় শিল্পীদের জন্য আগের দিনেই পোষাক সহ অন্যান্য দ্রব্য পরিচালক এনে রাখতেন যেমন, মাথার চুল,মুকুট,গায়ের ড্রেস,মেয়েদের মাথার চুল,বুক সহ অনেক কিছু ।নাটক শুরুর এক ঘন্টা আগেই প্যান্ডেলের চারি ধারে চারটি হ্যাজাক সাটানো হতো,হ্যাজাকের আলোয় মন্চসহ সারা মাঠআলোকিত হয়ে উঠতো ।
হ্যাজাক বাতি পরিচালনার জন্য আলাদা লোক ভাড়া করা হতো,মাঝে মাঝে হ্যাজাক বাতি পাম্প দিতে হতো। দলে দলে লোক এসে নাটক শুরু হওয়ার আগেই মাঠ কানায় কানায় পুর্ন করে ফেলতো।দর্শকদের বসার জন্য খেড় বিছিয়ে দেয়া হতো। সেদিনের সে রাতের কিযে অনুভূতি, কিযে আনন্দ,কিযে সুখ,সেটা বলে বুঝানো যাবে না।অভিনয়, হায়রে অভিনয়। গ্রামের সহজ সরল মানুষ গুলো প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে নাটক দেখতো, অভিনয় দেখতো তারপর নাটক শেষে গেলাপ গায়ে জড়িয়ে আবার দলেদলে গান গেয়ে গেয়ে যার যার বাড়ী ফিরতো।
আমরা গ্রামে বসবাস করতাম,তখনকার সময়ে যোগাযোগ ব্যাবস্হা মোটেও ভালো ছিলো না, জেলা শহরের সাথে অ্র্থ্যাৎ টাংগাইল শহর হতে জামালপুর শহরের সাথে সংযোগ পাকা চিকন সড়ক ছিলো।আমরা দলবেধে বানিয়াজান বাসষ্টেষন হতে মটর গাড়ীতে চড়ে জামালপুর শহরে যেতাম সিনেমা দেখতে। তখন জামালপুর শহরে তিনটি সিনেমা হল ছিলো তার মধ্যে কথাকলি সিনেমা হলটি ছিলো দেখার মতো,কথাকলি সিনেমা হলটি ছিলো তিনটি হলের মাঝখানে। কোনো ছবি আমরা বাদ দিতাম না ,কোন কোন সময় একি ছবি দুইবার তিনবার করে দেখতাম।
আমাদের বাড়ী থেকে সরিষাবাড়ী থানার দুরত্ব সাত আট কিলোমিটার পচ্শিমে,সেই থানা শহরে চম্পাকলি নামে একটি সিনেমা হল ছিলো, সেখানেও তৃতীয় শ্রেনীর টিকিট কেটে মাটিতে চট বিছানো থাকতো সেখানে বসে সিনেমা দেখতাম , শুধু যে আমরাই দেখতাম তা কিন্তু নয় কোনো কোনো সময় টিকিট পাওয়া যেতো না , তখন দালালদের কাছথেকে বেশী পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে সিনেমা দেখে হেটে হেটে অনেক রাত্রীতে বাড়ী ফিরতাম।
সেদিন রাতে আর খাওয়া জুটতো না,সকাল বেলায় বকাবকি তো আছেই ।মানুষ পাগলের মতো সিনেমা দেখতো।অনেক দিন পর আমাদের ধনবাড়ীতে দুইটি সিনেমা হল চালু হলো ,কিযে আনন্দ কিযে ফুরতি সেটা কাউকে বলে বুঝাতে পারবো না। চুরির মাত্রা বেড়ে গেল ,কোলার চাউল ,ছোপের বাস,হাসমুরগীর ডিম, খেতের ফসল সুযোগ পেলেই বেচে দিতাম , অনেক সময় বড় ভাইয়ের নিকট ধরাও খেতাম, কিন্তু সিনেমা দেখা বাদ দিতাম না।সিনেমা দেখাটা নেশায় পরিনত হয়েছিলো।
আশির দশকে সর্ব প্রথম তালুকদার বাড়ীতে রইচ উদ্দীন তালুকদার কাকা একটা বিশ ইন্চি সাদা কালো টেলিভিষন কিনে এনে এলাকায় সাড়া জাগিয়ে তুললেন । গ্রামেরসহজ সরল মানুষ টেভিশনের নাম শুনেছে কিন্তু চোখে টেলিভিশন দেখে নাই। কাকা খুব ভালো মানুষ ছিলেন, তিনি সবার জন্য টেলিভিশন দেখা উন্মুক্ত করে দিলেন ।
বড় বাড়ী। উঠানও অনেক বড়।কাকার ঘরের বারান্দায় টেবিলের উপর টেলিভিশন বসিয়ে চালু করে দিতেন, আর আমরা প্রায় দুই আড়াইশমানুষ উঠানে খড় বিছিয়ে রাত দশটা এগারটা অবধি টেলিভিশন দেখতাম । লম্বা বাসের মাথায় এনটিনা বাধানো থাকতো। এনটিনা নড়াচড়া করলে টিভি ঝিরঝির করতো, ছবি দেখা যেতো না।
তখন একটি মাত্র চেনেল ছিলো, ঢাকা চেনেল । নাটক গান আর বিগ্যাপন দেখে মন ভরে য়েতো। অনেক দুর থেকে নারী পুরুষরা পায়ে হেটে টেলিভিশন দেখতে আসতো। টেলিভিশন অনঅপ করা,চেনেল ঠিক করা সব কিছুই ফটিক ভাই করতো, অন্য কউ টেলিভিশনে হাত দেয়ার সাহস পেতো না, তার কারন যদি টেলিভিশন নষ্ট হয়ে যায় এই ভয়ে।
কলের গানের প্রচলন অনেক আগে থেকেই ছিলো, যেকোন গ্রামীন অনুষ্ঠানে কলের গানের কোন বিকল্প ছিলো না, বিশেষ করে বিয়ে বাড়ীতে কলের গান সারাদিন বাচতো, রাতেও বাচতো । কলের গান অ্র্থাৎ মাইক দুইদিন অথবা তিন দিনের জন্য ভারা করে আনা হতো।কলের গান না বাজলে সেটা বিয়ে বাড়ী বলে মনে হতো না, বউ ঝিদের আনন্দ হতো না,বিয়ে বাড়ীতে আত্বীয় স্বজন,জামাই জিরাতে ভরে যেতো।খাওয়া দাওয়া দেধারছে চলতো।
একটা বিষয় উল্রেখ করা খুবই প্রয়োজন তাহলো, কোন বাড়ীতেই তখনকার সময়ে তালুকদার বাড়ী ব্যাতিত, লেটটিন বাথরোম ছিলো না, সবাই আরা জংগলে বসেবদনায় জল ভরে পায়খানা প্রশ্রাব সেরে আসতো ।মেয়েদের জন্য চাটাই দিয়ে বেড়া করে দুইটা ইট বিছিয়ে প্রশ্রাব করার ব্যাবস্হা করা হতো। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে রাতের বেলায় খেত খামারে জরুরী প্রাকৃতিক কাজটি সমাধান করা হতো।
রেডিও পাকিস্তান,দেশ স্বাধনি হওয়ার পর রেডিও পাকিস্তান এর পরিবর্তে বাংলাদেশ বেতার হল । সে আমলে রেডিওর অনেক সমাদর ছিলো। আমাদের সারা গ্রামে রেডিও ছিলো মাত্র তিনটি , একটা আমাদের বাড়ীতে নাগমা টু ব্যান্ড রেডিও , তালুকদার বাড়ীতে ফিলিপস, এবং পাল বাড়ীতে একটি ফিলিপস রেডিও বাচতো। সকালে দুপুরে এবং রাতে গ্রমের মানুষ নারী পুরুষসহ আমাদের বাড়ীতে আসতো নীনা হামিদ, আব্বাছ উদ্দিন, আব্দুল আলীম সহ অনেক শিল্পীর গান ,নাটক ,এবং খবর শুনতে।
একমাত্র আমার বড় ভাই মোজাফ্ফর সরকার ছাড়া রেডিওতে কেউ হাত লাগাতো না, যদি রেডিও নষ্ট হয়ে যায়। নীনা হামিদের গানের সময় আমি একবার রেডিওর ভলিয়ম বাড়িয়ে দিয়েছিলাম বড় ভাই তৎক্ষনাত এসে আমার গালে বড় ধরনের একটি চড় লাগিয়ে দিয়ে শাসন করে বললো, আর কথনো রেডিওতে হাত দিবি না। কলকব্জার জিনিস যদি নষ্ট হয় ইত্যাদী। সারা গ্রামে হারিকেন ছিলো হাতে গোনা। আমরা সাধারনত দোয়াতেই পড়া শুনা করতাম ।
রাতের পড়াশুনা অধিকাংশ সময় দিনেই শেষ করতাম তার কারন, কেরোসিন তেলের অনেক দাম ছিলো। আমার সৎমা রাতের বেলা দোয়াত জ্বালিয়ে পড়াশুনা করতে তেমন দিতেন না ,,,,সে অনেক কথা। স্কুলে মাটিতে বর্ণমালাশিখতে হতো, তার পর কলাপাতায় পাতিলের কালী গুলিয়ে বাসের কন্চি দিয়ে কলম বানিয়ে সেই কালি দিয়ে বর্ণমালা লিখতাম। লিখতে না পারলে বেদম প্রহার করতো বকশি মাষ্টার।
কয়েক বছর পর গ্রামে প্রায় সব বাড়ীতে টিভি এসে গেছে, বাড়ীতে বাড়ীতে টিভির এনটিনা দেখা যায়,তার পর আসলো ডিবিডি, ভিসিয়র, এর আগে এসেছে টেপ রেকডার,সে এক ইতিহাস, ক্যাসেটের মধ্যে পাতলা চিকন ফিতার সাহায্যে অবিরত গান শুনা য়ায়। বিভিন্ন শিল্পীর গানের ক্যাসেট এনে পরেশ দাদার বাড়ীতে শুয়ে বসেএকসংগে মনের মতো গান শুনতাম। আর কাসার থালাতে আগুনের কয়লা ঢেলে গরম করে কাপড় ইস্ত্রী করতাম, তখন ছিলোই একটা মাত্র শার্ট,কাগজ কলমের তো প্রশ্নই আসে না , লুংগী বা তফন পরে স্কুলে যেতাম।
আমাদের গ্রামে বড়দের, জনতা কল্যান সমিতি নামে একটি সমিতি ছিলো।সেই সমিতিতে একটি বইএর লাইব্রেী ছিলো । আমরা এক সপ্তাহের জন্য পচিশ পয়সা দিয়ে একটি বই এনে পড়তাম,আমি আবার নিয়মিত ভাবেই বই আনতাম এবং পড়তামও।মাসে একবার সমিতির মিটিং হতো,মিটিংএ অনেক সময় সদশ্যদের মধ্যে হিসাব নিয়ে এবং অন্যান্য কাজে হৈচই হতো,আবার মিলমিশও হতো ,সভা শেষে ঝাল মুড়ি খেয়ে সবাই চলে যেতো। এখন সেই সমিতিও নাই লাইব্রেীও নাই আর সেই চেনাজানা মানুষ গুলোও নাই।
সেকালে মানুষের মধ্যে অনেক সম্প্রীতি ও প্রচন্ড মিল মহাব্বতছিলো। একজন আরেকজনের বাড়ী হরহামেশাই যাতায়াত করতো, একে অপরের খোজ খবর রাখতো। বিয়ে সাধী আচার অনুষ্ঠানে দাওয়াত বিনিময়ের প্রচলন ছিলো। কোন লোক অসুস্হ্য হলে প্রায় সবাই তাকে দেখতে যেত। আর সবচাইতে বড় একটি রেওয়াজ দেখা যেত তাহলো,কোন লোক মারা গেলে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসতো ।
মানুষজন খুব কান্নকাটি করতো, নাওয়া খাওয়া প্রায় বাদ দিয়ে দিতো । মানুষ গুলো সহসা মিথ্যা কথা বলতোনা,, প্রতারনা বুঝতো না,চালাকী বুঝতো না,ফাকি দেওয়া বুঝতো না,ওজনে কমতো দিতোই না, খাদ্যে বিষ দেয়া, ফরমালিন মিশানো এ গুলোর কোন অস্তিত্বই ছিলো না,মোটা চাউল মোটা ভাত ,মোটা কাপড় পড়ে মানুষজন খুব সুখেই ছিলো, হিংসা ,বিদ্যেশ এর বালাই ছিলো না। শীতের দিনে দুধের পিঠা ,কুলি পিঠা , কলা পিঠা আরো কতো ধররেনে পিঠা যে তৈরী হতো তার কোন শেষ নেই, নতুন, পুরাতন জামাই জিরাত ও পাড়া প্রতিবেশী, আত্বীয় স্বজন সবাইকে গ্রামে আসার জন্য দাওয়াত করা হতো। তারা আসতো গ্রামে, আনন্দ করতো, ফুরতি করতো অর্থাৎ শীতকালটাগ্রামীন জীবনে একটা উৎসব কাল হিসাবে পরিচিত ছিলো।খাওয়া দাওয়ার কোন কমতি ছিলো না।
আধুনিক সমাজ ব্যাস্হা আমারদের দৈনন্দিন জীবন আচরন অনেক বদলে দিয়েছে, আমরা অজানা অনেক জিনিসকে হাতের মোঠয় পেয়ে নিজেদেরকে ধন্য মনে করছি, আমাদের যাতায়াত ব্যাবস্হা ,খাওয়া দাওয়া, পোষাক পরিচ্ছদ, লেনদেন ,ব্যাবসা বানিজ্য, ভাবের রীতিনীতি , উঠাবসার মধ্যে আমুল পরিবর্তন এসেছে। পুরো পৃথিবীটাএখন প্রতিটি মানুষের হাতেরমুঠোয়, ফলে যেটা হয়েছে তা হলো, আমাদের প্রত্যেকটা বিষয়ে ,প্রত্যেকটা রীতিনীতিতে , প্রতিটি মানুষের স্বভাবে, কর্মে,ফুটে উঠেছে অসম্ভবধরনের চালাকি, ভেলকি বাজি।
বিগ্ঙান দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ।বিষয় এমন দাড়িয়েছে যে, যদি বলি, হও ,সংগে সংগে অনেক বিষয় হয়ে যায়, প্রত্যেক বিষয়ের কৌশলটা শত গুনে উন্নত হয়েছে,মানুষের ধ্যান ধারনার ক্ষেত্রে উন্নত বৈশিষ্ঠ লক্ষ করা যায় না, ধনদৌলতের অভাব নাই, কিন্তু বাহির থেকে বুঝা যায়, ,ভিতরটা তার শুকিয়ে আছে,নামাজরোজা ,ধর্মকর্ম সবই করছে, কিন্ত মানুষের সাথে আচরনগত দিক খুবই নিকৃষ্ট , আমাদের মা, খালা,চাচীরা পাচ ছয়জন ছেলেমেয়ের মা হয়ে একান্ন পরিবারে বহাল তবিয়তে সংসার ধর্ম পালন করে গেছেন, এখন এক ছেলে একমেয়ে নিয়ে অথবা এক মেয়ে বা একছেলে নিয়ে আমাদের বউরা পাগল প্রায়, শ্বশুর শাশুড়ী, পিতামাতা ভাই বোন দেখলেই মাথা নষ্ট,রান্নাবাড়া নট।
আলোচনার প্রথম ধাপ থেকে আসি তা হলো, সিনেমা দেখা, সত্যি বলতে কি, সিনেমা দেখি না আজ হতে প্রায় পচিশ বছর যাবৎ। পেশাগত কারনে, বিয়ে বসার কারনে, ছেলে মেয়েদের দেখভাল করার কারনে , বউএর জ্বালা যন্ত্রনা হজম করার কারনে , অফিসের বসদের তাবেদারি, কলিকদের পিছু লাগা, অন্যান্য বউএর প্রেমে পড়া, পরকিয়ায় পড়া,কোন কোন সময় বেহুদা কাজে জড়িয়ে পড়া, সিবিএ এর কাজে অহেতুক ব্যাস্ত থাকা, আবার অফিসার সমিতির বিভিন্ন কর্মকান্ডে সময় ব্যয় করা, ইত্যাদী কাজে সিনেমা হলে ঢুকার আর সময় পাইনা।
এর মধ্যে মোবাইল ফোন এসে জীবনটাকে আরো বেশী তজনজ করে ফেলেছে। নকিয়া ফোন সেটটি কিছুটা রক্ষা করেছে কিন্ত পরবর্তীতে আরো উন্নত ফোন সেট আসার কারনে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে আমাদেরকে দাড় করিয়েছে, তার কারন, আগে তবু বইপুন্তক কিনতাম, গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তাম, অর্জন করতাম মেধা, হায়রে পৃথিবী, জীবন টাকে এমন একটা পর্যায়ে দাড় করিয়েছে যে,সেই ফোনসেট ছাড়া এক মুহুর্ত চলে না।মোবাইল সেটের ব্যাখ্যা দেয়া আমার পক্ষে কখনো সম্ভব নয়।
টাংগাইল শহরে একটি সিনেমা হলও নাই,সব ভেঙে বড়বড় দালান কোঠা নির্মান করা হয়েছে।এইভাবে সারাদেশ ব্যাপি সিনেমা হলগুলো ভেঙে বাসাবাড়ী, ফেক্টরী, গোডাউন, তেলের মিল, ময়দার মিল, স মিল ইত্যাদী তৈরী করে সংস্বৃতির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে, নায়ক নায়িকারা এখন সিনেমা থেকে সরে গিয়ে নির্বাচনের প্রচার প্রচারনায় মেতেছেন , জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহন করে জনগনের দ্বারপ্রান্তে ভোট প্রার্থনা করছেন ।
আমাদের সুনামধন্য নায়ক নায়িকা, গায়িকা ,ত্রিকেট খেলোয়ার সাকিব, মাশরাফি সহ হিরু আলমও মাঠে আছেন। স্কুল, কলেজ, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাঁদের লাইব্রেরী সাজানোর জন্য বই কেনা ছাড়া সাধারন পাবলিক এখন আর বই পুস্তক কেনেন না,পড়েনও না । কাউকে কোন অনুষ্ঠানে বই উপহার দিলে সে খুব বিরক্ত হয়,গরীব বলে মনেমনে গালী দেয়।কানাডা প্রবাসী জাকির ভাই তার মেয়ের বিয়েতে আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলো, রাতে সিলমিতে অনুষ্ঠান, দাওয়াতে যেতে হবে, সারাদিন একেবারই মনে ছিলো না, য়খন মনে হলো, তখন শহরের সব দোকান পাট বন্দ হয়ে গেছে ,একটা গিফটতো দিতে হবে, কি করি, সংগেসংগে রিকসা নিয়ে শহরের সব জায়গায় দোকান খুজলাম কিন্ত ব্যর্থ হয়ে ভিক্টরিয়া রোড হয়ে দাওয়াতে না গিয়ে বাসায় চলে আসব, এমন সময় দেখি, কাদের ভাই তার বইএর দোকান বন্দ করে দোকানের সামনেই দাড়িয়ে সিগারেট টানছেন, কাদের ভাইকে দেখে বড়ই আস্হস্ত হলাম, তাড়াতাড়ী রিকসা থেকে নেমে কাদের ভাইকে বললাম ,লাইব্ররী খুলুন, বইএর জরুরী প্রয়োজন, আটশত বিশ টাকা দিয়ে দুইটি বই মলাট বদ্ব করে বিয়েতে উপহার দিয়ে দাওয়াত খেয়ে বাসায় চলে আসলাম, মনে একটা প্রশান্তি,শেষমেশ মেয়েটাকে একটা কিছু দিতে পেরে ।
দুইদিন পর জানতে পারলাম, জাকির ভাই আমাকে উদ্দেশ্য করে আমার এক বন্ধুর নিকট বলেছেন, আমি নাকি তার মেয়ের বিয়েতে দুইগাছ বাল উপহার দিয়েছি।
এখন মানুষ মারা গেলে কেউ আর শোকআফসোছ করে না, নিকটজন এবংনিকট আত্বীয় স্বজন ঘন্টা খানিক কান্না কাটি করেন তারপর মাটি হয়ে গেলে মৃতব্যাক্তির সম্পত্তীর ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে নিজেদের মধ্যে এবং ওয়ারিশানের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই বা কানাঘোষা চলতে দেখা যায়, তারপর এক মাসের মধ্যেই মারামারি কাটাকাটি , শালিশ দরবার ,তারপর মামলা মোকদ্দমা,হাজতবাস শেষে জেলখানায়ও আশ্রয় নিতে দেখা যায়। এ ধরনের ঘটনা এখন শহর গ্রাম সব খানেই হচ্ছে।
স্কুল কলেজে খেলার মাঠ আছে, কিন্ত খেলাধুলা নাই,শহরে সরকার বাহাদুর অনেক টাকা খরচ করে বড় বড় ষ্টেডিয়াম তৈরী করে দিয়েছেন কিন্ত তাতে খেলাধুলার তেমন কোন সাড়া পাওয়া যায় না। গ্রামের বিদ্যালয়ের মাঠের অবস্হা আরো শোচনীয়, সারাদিন খেলার মাঠে গরু, মহিশ, ভেরা ছাগল চড়ে, সন্ধ্যার পরে ছাত্ররা কজন মিলে স্কুল ঘড় থেকে ব্রেন্চ বেড় করে রাত দশটা এগারোটা পর্য্ন্ত সাতআট দশজন বসে মোবাইল বাবাজির সাথে গেমখেলা সহ অন্যান্য খেলায় মেতে থাকে।
ফুটবল নেই,ভলিবল নেই,ব্যাডমিন্টন নেই, হাডুডু নেই, গলফ নেই, ত্রিকেট টা ছিলো,সেটারও বারোটা বেজে গেছে।আগে প্রায় সব গ্রামেই ক্লাব, সমিতি ছিলো বিনোদনের জন্য, এখন তা আর খুজে পাওয়া যায় না,হয়তো কিছু থাকতে পারে। শহরে অনেক সমিতি, ,ক্লাবআছে, সেখানে কোন কোন ক্ষেত্রেবিয়ে সাধীর অনুষ্ঠান হয় , টাস খেলা, কেরাম খেলা, টেবিল টেনিস খেলা, সহ অন্যান্য কিছু খেলা হয়, এতে তেমন শরীর চর্চা হয় না ।
মিথ্যা বলা মহাপাপ, সেই মিথ্যা কথা বলা এখন সাধারন রেওয়াজ হয়ে গেছে,প্রতারনা, ছলনা, চুরি ডাকিাতি ,জাল জালিয়াতি, ঘুষ, দুরর্নীতি,ফাকিবাজি,ধোকাবাজি, সহ নকল ডিম, নকল মেডিসিন, মোটা চাউল চিকন করে বাজারজাত করন, ওজনে কম দেয়া, সকল প্রকার ফলের মধ্যে বিষ মেশানো,শাক সবজী তরুতরকারিতে বিষ মেশানো, মাছের মধ্যে ফরমালিন মেশানো, কুকুরের মাংস টাকে খাসির মাংস বলে বিরিয়ানি খাওয়ানো,গরুর মাংসে বিষ মেশানো,তারপর চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনিয়মের কথা বাদ দিলেই মনে হয়, ভালো হয়।
বাবা মায়ের সাথে দুর্ব্যাবহার,পরিবারের সাথে দু্র্ব্যাবহার, সমাজের সাথে দুর্ব্যাবহার, দেশ ও জাতীর সাথে দুর্ব্যাবহার,মদপান করা ,জোয়ার আসরে বসা, ক্যাসিনো খেলা, পরকিয়ার মতো জঘন্য মিলনে অভ্যস্হ থাকা,সামর্থ্ থাকা সত্বেও বৃদ্ব মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা, জনগনের সম্পদ লুন্ঠন করে বিদেশে পাচার করা, মানুষ খুন করা, এমন কোন কাজ নেই যা আমাদের সমাজে প্রচলিত নাই, খোদাতালা বলতে যে একজন আছেন, সেবিষয়ে মানুষের কোন ভয়ভৗতি নেই,সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা হরহামেসায় নানা প্রকার অশ্লিল দৃশ্য দেখতে , বুঝতে হজম করতেও হচ্ছে।
তাই, আসুন আমরা অন্ততপক্ষে ১৫% ভালো হয়ে একটা দৃষ্টান্ত স্হাপন করে যাই,দেশ এবং জাতীর কাছে আগামী প্রজন্মকে উপহার দিয়ে যাই। পাপের শেষ সিমানায় আমরা কোনভাবে দাড়িয়ে আছি, মাহান খোদা শাস্তি প্রদানে ধীর, বন্যা, খরা, প্লাবন সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভুমিকম্পের মতো মহা অভিশাপ তো পিছনে ওৎ পেতেই আছে,যে কোন সময় শহর নগর জনপথ, দালান কোঠা, মানুষ,জীব জন্তু, পশুপাখী ধ্বংশ হয়ে, সব কিছু বিলীন হয়ে যাবে, কোন কল্পিত খোদা আমাদের রক্ষা করতে পারবে না।হে পৃথিবীর সকল মানুষ, কান থাকলে শোন, চোখ থাকলে দেখ, চারিদিকে ভুমিকম্পের মহা ছোবলে দেশ ,জাতি, মানুষ, দালান কোঠা, জনপথধ্বংশের দ্বারপ্রান্তে।
হে আমাদের মহান খোদা, আমাদের রব, আমাদের সকলকে তোমার রহমতের চাদরে ঢেকে রাখ,আমরা তোমার নিকট ক্ষমা চাই, পাণা চাই, আমাদের উপর রহম করো, আমরা নিশ্চয়ই ভালো কাজ করব এবং ভালো হয়ে যাব।আমীন।