ডেস্ক রিপোর্ট : ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর ঘোষণাপত্র –
পরিবেশ বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বর্তমানে মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনছে। ঘনবসতিপূর্ণ ব-দ্বীপ অঞ্চল বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বরং পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেক বেশি ঝুঁকির মুখে থাকা একটি দেশ।
চলমান উন্নয়ন ধারণা, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাবহার বৃদ্ধি, নদী-খাল ও অন্যান্য জলাশয় দখল ও দূষণ, পাহাড় কাটা, বন নিধন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ নানাভাবে আমরা আমাদের বাস্তুসংস্থান, পৃথিবী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চরম ক্ষতি সাধন করছি।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী গোষ্ঠী ও দেশসমূহের বেপরোয়া কর্মকান্ড বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে শাসক শ্রেণীর দুর্বলতা এই পরিস্থিতেকে আরো খারাপ করার পাশাপাশি আমাদেরকে একটি মহাসংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা পরিষ্কারভাবে একটি অন্যায্যতা যা এই সংকটে সবচেয়ে বেশী হুমকির মুখে থাকা বাংলাদেশ ও সারা বিশ্ববাসীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল।
জলবায়ু ও বাস্ততান্ত্রিক সঙ্কটময় পরিস্থিতির কারণে গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরণের নেতিবাচক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করছে। একইসাথে এসকল কারণে, জনগণের জীবন-জীবিকার ক্ষতি, ব-দ্বীপ বাস্তুসংস্থানের ধ্বংস সাধন, তীব্র পানি ও বায়ু দূষণ, সমূদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় এলাকার মানুষদের বাস্তুচ্যুতি, লবণাক্ততা, সুপেয় পানির সংকট, শক্তিশালী ঘুর্ণিঝড় ও বন্যাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা দিনদিন বেড়েই চলেছে। গবেষক ও বিজ্ঞানীদের মতে, ইতোমধ্যে এই বিপর্যয়ের কারণে প্রায় ১ কোটি বাংলাদেশি মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া হতে হয়েছে যা অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু-উদ্বাস্তু সংকটকে আরও তীব্র করে তুলবে।
বাংলাদেশের মোট বনাঞ্চলের ৪০ ভাগ জায়গাজুড়ে থাকা ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন শুধুমাত্র এ অঞ্চলের বাস্তসংস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণই নয় বরং বাংলাদেশকে জলবায়ু দূর্যোগ থেকে রক্ষায় প্রাকৃতিক বর্ম হিসাবে কাজ করে।
কিন্তু অত্যন্ত আশংকার কথা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এই সুন্দরবনের উপরও ব্যপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এক কথায় বলা যায়, ডেল্টাপ্ল্যান ২১০০ অনুসারে, বাংলাদেশকে যে ৬টি বাস্তুসংস্থানগত অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে, তার সবগুলোই আজ চরম পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন। তাই, আমরা জলবায়ু ও পরিবেশগত ন্যায্যতার জোরালো দাবি জানাই!
উল্লেখিত বিষয়গুলোকে তুলে ধরে চলমান নানা উদ্যোগের মত ২০২৩ সালে নভেম্বর মাসের ১৭-১৮ তারিখ ঢাকায় ইউ এন ডি পি বাংলাদেশসহ ২৭টি জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংগঠন যৌথভাবে জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশের আয়োজন করে। এতে উপকূল, হাওর, পাহাড়, বরেন্দ্র অঞ্চলসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পক্ষে সাতশরও বেশি স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। এই সমাবেশ বাংলাদেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় ভুক্তভোগীদের জন্য জলবায়ু ন্যায্যতার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসতে একটি শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানায়।
যেহেতু আমরা বাংলাদেশের জনগণের পরিবেশ ও জলবায়ু ন্যায্যতার সংগ্রাম ও অভিপ্রায়কে সামনে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। তাই, নবগঠিত সংগঠন “ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)” নিম্নোল্লেখিত বিষয়গুলোতে প্রতিশ্রুতি ব্যাক্ত করছে :
১. একটি সম্মিলিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক (বয়স, লিঙ্গ, বর্ণ, জাতিগত পরিচয়, ধর্ম, মানবিক ও অবস্থানগত শ্রেণী নির্বিশেবে) স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠন হিসেবে এটি ব্যক্তি, সমাজ, জনগণের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম ও সংগঠনগুলোকে নিয়ে কাজ করবে যারা মূলত পরিবেশ রক্ষায় জন-আকাঙ্ক্ষা ও দাবির পক্ষে সংগঠিত হয়েছে। এটি বিশেষভাবে পরিবেশগত এবং জলবায়ু ন্যায়বিচার, সেই সাথে পরিবেশগত পুনরুদ্ধার, সংরক্ষণ ও উন্নয়নের উপর গুরুত্বারোপ করবে।
২. আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ এবং সমগ্র ধরিত্রীকে বিষাক্ত এবং ক্ষতিকর দূষক নিঃসরণের ফলে জনগণের অমানবিক ভোগান্তি থেকে রক্ষা করার জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি দূষণকারীদের সাথেও অধিপরামর্শ ও সমন্বয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
৩. উপযুক্ত ও নিরপেক্ষ নীতি ও আইন প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে সরকার ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে উদ্বুদ্ধ করবে এবং যথাযথ সহায়তা প্রদান করবে।
৪. ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ এবং সম্প্রদায়কে সংগঠিত করার লক্ষ্যে সংগঠনের প্রয়োজনীয় কর্মপদ্ধতি ও কর্মসূচি নির্ধারণ করাসহ সচেতনতা তৈরি করা এবং বিভিন্ন বিষয়ে বৃহত্তর আন্দোলন এবং উদ্যোগকে সাথে নিয়ে পরিবেশ ও পতিবেশগত বিপর্যয়ের প্রতিক্রিয়া এবং বিকল্প সমাধানগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবগুলিকে মোকাবেলা করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সচেষ্ট থাকবে।
৫. যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, সরকারি বরাদ্দ ও প্রাকৃতিক সম্পদের অভিগমনের ক্ষেত্রে যেন ক্ষতিগ্রস্থদের স্বার্থ সর্বাধিক গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার পায় সেই লক্ষ্যে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণসহ সম্পূর্ণ সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে তৎপর থাকবে।
৬. বাস্ততন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং পরিবেশ ও জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
৭. জলাশয় দখল, পানি ও বাতাসদূষণ, বন উজাড়, মরুকরণ, মাটির অবক্ষয়, ক্ষয়-ক্ষতি এবং মৎস্যজীবী, কৃষক, নারী, শিশু ও ভিন্নভাবে সক্ষম জনগোষ্ঠী ছাড়াও অভিযোজন ও প্রশমনসংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্থানীয় পর্যায়ে বিরূপ প্রভাব সম্পর্কিত উপযুক্ত ও দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করাসহ বিশ্বাসযোগ্য তথ্য ও উপাত্ব সংগ্রহ করতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী-ভিত্তিক অংশগ্রহণমূলক পরামর্শ, পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা প্রদান করবে।
৮. পারস্পরিক ক্রিয়াশীল নদী-কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও প্রোটোকলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত নদী সমস্যা ও অন্যান্য বিরোধ নিষ্পত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ; এবং সমগ্র অঞ্চলের মানুষের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিতে অত্যাবশ্যকীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট বহুপাক্ষিক অভিন্ন ও অমীমাংসিত বিষয়গুলোকে সমাধান করার মাধ্যমে সর্বনিম্ন নদী অববাহিকায় অবস্থিত ব-দ্বীপের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় সচেষ্ট থাকবে।
৯. সরকারি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগ এবং পারস্পরিকভাবে প্রয়োজনীয় অংশীদারিত্বকে জনগণের পক্ষে, পরিবেশ-বান্ধব, এবং পরিবেশগতভাবে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি কাঠামো এবং কৌশল বিকাশের জন্য উৎসাহিত করবে। সেই লক্ষ্যে দক্ষতা অর্জনের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা এবং যথাযথ প্রযুক্তিগত উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
১০. সংশ্লিষ্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবাধিকার চুক্তি ও প্রটোকল সম্পর্কে সকলকে পরিচিতিকরণ এবং প্রচারের ব্যাবস্থা গ্রহণ করবে।
১১. বয়স, লিঙ্গ, জাতি, বর্ণ বা ধর্ম, আঞ্চলিক ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা বা সীমানা নির্বিশেষে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সুবিধার জন্য জলবায়ু তহবিলের উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে জনগণের স্বার্থ অগ্রাধিকার দেওয়াকে সর্বদা উৎসাহিত করবে।