রাজশাহী: সেমিস্টার ফাইনাল পরিক্ষা শেষ। হাফ ছেরে বাঁচলাম। মনে হচ্ছে যেন কাধ থেকে অনেক বড় একটা বোঝা নেমে গেল। ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। কিন্তু আর্থিক সংকট। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করলাম। কিন্তু যাদের সাথে যাওয়ার কথা তাদের বেশির ভাগই গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে। মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল। অবশেষে কাছের দুইজন বন্ধু ঘুরতে যেতে রাজি হলো। তিন জনে মিলে ঠিক করলাম সাজেক-ভ্যালিতে ঘুরতে যাব। সব পরিকল্পনা সুন্দর ভাবে করলাম। অগ্রিম টিকেটও কাটা হলো। অপেক্ষা শুধু সাজেক যাওয়ার।
১৮ তারিখের টিকেট কাটা হয়েছে। ১৭ তারিখ রাত ৮ টার দিকে আমি ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম। এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠল। দেখলাম হাবিবের ফোন। বলে রাখা ভালো আমার সাথে যে দুইজন বন্ধু ঘুরতে যাচ্ছে তাদের একজন হচ্ছে হাবিব অন্যজন নাইম। ফোন রিসিভ করার সাথে- সাথেই হাবিব বলতেছে ''কোথায়রে তুই। বললাম আমি তো রুমে ব্যাগ গোছাচ্ছি। ও বললো ব্যাগ গোছানো পরে হবে তুই আগে একটু বাইরে আয়। জরুরি কথা আছে। বললাম কিরে কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? ও বললো তেমন কিছু না। দরকারি কথা আছে। বললাম দরকারি কথা হলে আমার রুমে আয়। রুমে কেউ নাই। রুমমেট ছুটিতে বাসায় চলে গেছে। কিছুক্ষণ পর হাবিব একটা পেপার হাতে নিয়ে আমার রুমে আসলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম কিরে কি হয়েছে। বললো পরে বলছি আগে নাইমকে আসতে বল। ফোন দিয়ে নাইমকে আসতে বললাম। কিছুক্ষণ পর নাইমও আসলো।
তারপর হাবিব পেপারটা আমার হাতে দিয়ে একটা নিউজ পড়তে বললো। আমার পেপার পড়ার অভ্যাস নাই। তাই পেপারও সেভাবে পড়া হয়না। নিউজটা পড়ে যা বুঝতে পারলাম ইষিকা নামের ৬ বছরের একটি শিশু ৪ দিন হলো নিখোঁজ। তার মুক্তিপনের জন্য ১০ লক্ষ টাকা দাবি করা হয়েছে। তার বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোট একটা পোস্টে চাকরি করে। তার পক্ষে ১০ লক্ষ তো দূরেই থাক ৫ লক্ষ টাকাও জোগাড় করা সম্ভব না। জমিজমা বিক্রি করে অল্প কিছু টাকা জোগাড় করেছে। কি সময় দেওয়া হয়েছে মাত্র ৭ দিন। ৭ দিনের ভেতর টাকা না দিতে পারলে ঈষিকাকে মেরে ফেলা হবে।" পেপারটা হাত থেকে রেখে আমি আর নাইম হাবিবকে বললাম এসব খবর তুই আমাদের দেখাচ্ছিস কেন? উত্তরে হাবিব বললো কাল আমার সাজেক যাচ্ছি না। শুনে আমর আর নাইমের মাথা গরম হয়ে গেল।
বললাম কিরে তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি। টিকেট কাটা হয়ে গেছে আর তুই এখন বলছিস ঘুড়তে যাওয়া হচ্ছে না। উত্তরে হাবিব বললো আমরা মেয়েটাকে উদ্ধার করবো। আমি বললাম আমরা কি পুলিশ নাকি গোয়েন্দা যে মেয়েটাকে উদ্ধার করবো। হাবিবকে কোনো ভাবেই বোঝাতে পারলাম না। প্রায় এক ঘন্টা আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি চললো। অবশেষে আমরা ঘুড়তে যাওয়া বন্ধ করলাম। তখন আমাদের মনে হলো দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব আছে মেয়েটিকে খুজে বের করা। ঘুড়তে যাওয়া বাদ দিয়ে মেয়েটিকে খুজে বের করার পরিকল্পনা করতে শুরু করলাম। আমাদের মধ্যে হাবিবের প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল। আমাদের কারো কোনো টেকনিক্যাল সমস্যা হলে হাবিবই সমাধান করে দেয়।
চিন্তা- ভাবনা করতে করতে রাত ১১ টার দিকে হাবিব একটি বুদ্ধি বের করলো। যেসব নাম্বার থেকে মুক্তিপণের জন্য ফোন আসতো তার কিছু নাম্বার পেপারে দেওয়া ছিল। সেখান থেকে একটা নাম্বার হাবিব ট্র্যাক করতে সক্ষম হয়। লোকেশনটা ছিল বান্দরবানের একটা জঙ্গল। আমরা এক মুহূর্ত দেরি না করে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাদের টিকেট ছিল রাঙ্গামাটির তাও আবার পরের দিন সকালের। তাই নতুন করে আবার টিকেট ব্যাবস্থা করতে হলো। বাসের মধ্যে সবাই ব্যাস্ত। কিন্তু আমরা তিন জন অন্যমনষ্ক। চিন্তা শুধু একটাই কিভাবে ইষিকাকে উদ্ধার করবো। বান্দরবান পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরের দিন দুপুর হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত আমরা তেমন কিছু খায়নি। টাকা-পয়সাও খুব বেশি আনিনি। আর চিন্তার সময়ে তেমন কিছু খাওয়াও যায় না। আমাদের চিন্তা হতে লাগলো আমরা কি পারবো ইষিকাকে বাঁচাতে। আমরা কি ঠিক জায়গাতেই যাচ্ছি। সময় আছে আর মাত্র দুই দিন।
এর মধ্যে উদ্ধার করতে না পারলে হয়তোবা কোনো দূর্ঘটনা ঘটে যাবে। আমরা যে এত বড় মিশন নিয়ে এসেছি এটা আমরা তিন জন ছাড়া আর কেউ জানে না। এমনকি আমাদের পরিবারেরও কেউ জানে না। পরিবারের সবাই জানে আমরা ঘুড়তে এসেছি। আমরা একটা নিম্ন মানের হোটেল ভাড়া করলাম। কারণ যত টাকা বাঁচাতে পারি ততই আমাদের জন্য ভালো। কখন কোথায় টাকা লাগবে কে জানে। রাতে হোটেলে বসে তিন জন চিন্তা-ভাবনা করতে লাগলাম আর ঠিক করলাম কাল ভোরেই আমরা বের হয়ে যাব। কারণ হাতে সময় আছে আর মাত্র এক দিন। ট্র্যাক করা লোকেশনে আমরা ঠিকঠাক মতো পৌঁছাতে পারলাম না। সারা দিন অনেক চেষ্টা করেও কোনো লাভ হলো না। বিষন্ন মন নিয়ে সন্ধ্যায় রুমে ফিরে আসলাম। খুজে পাওয়া সম্ভবইবা কিভাবে অচেনা একটা জায়গা।
চিনি না জানি না কোথায় থেকে সেই জঙ্গল খুজে বের করবো। আজকে ছিল সপ্তম দিন। রাতে তিন জন মন মরা হয়ে বসে রইলাম। রাতের খাবারও খেলাম না। সত্যি বলতে আমার অনেক কান্না পাচ্ছিল। মাথায় শুধু একটা কথায় ঘুড় পাক খাচ্ছিলো মেয়েটাকি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে। হঠাৎ হাবিব বলে উঠলো কাল আমরা আরার খুজতে বের হবো। প্রয়োজনে মেয়েটার লাশ উদ্ধার করবো। আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলাম। হাবিব সারা রাত লোকেশন ট্র্যাকিং করার চেষ্টা চালিয়ে গেল। ফজরের নামাজের পর পরই আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম তবু হাল ছাড়লাম না। অবশেষে গহীন জঙ্গলে আমরা একটি বাড়ি দেখতে পেলাম। পরিত্যক্ত বাড়ি। আশেপাশে কোনো জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বাড়িটি দেখে মনে আশা জাগলো। মনে মনে ভাবলাম এই বাড়িতেই হয়তো ইষিকাকে আটকে রেখেছে।
কিন্তু হঠাৎ মনে পড়লো এই বাড়িতেই যদি মেয়েটাকে আটকে রাখে তাহলে তো পাহাড়া দেওয়ার জন্য কেউ না কেউ থাকতো। নাকি মেয়েটাকে মেরে ওরা চলে গিয়েছে। এই কথা ভাবতেই পা পাথর হয়ে আসলো। সাহস নিয়ে আস্তে-আস্তে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভাঙা চুড়া একটি কাঠের তৈরী ঘড়। ঘড়ে একটাই রুম। রুমে ঢুকতেই তিন জন চমকে উঠলাম। একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পাড়লাম না। বাঁশের একটা খুটির সাথে ফুটফুটে সুন্দর একটি বাচ্চাকে বেধে রাখা হয়েছে। বাচ্চটি ঘুমিয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সফল মানুষ আমরা তিনজন। ইষিকাকে আমারা ফিরে পেয়েছি। তাও আবার জীবিত অবস্থায়। কিন্তু মনের ভিতর একটা খটকা লাগলো যারা কিডন্যাপ করেছে তারা কোথায়। কোনো পাহাড়া ছাড়াই তারা রেখে গেছে। যাইহোক সময় খুবই কম। তাড়াতাড়ি এই জায়গায় থেকে চলে যেতে হবে। মেয়েটাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললাম। আমাদের দেখেই মেয়েটি কান্না শুরু করলো। আমরা ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম।
কিন্তু মেয়েটি কথা বলতে পারলো না। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম মেয়েটি আসলে কথা বলতে পারে না মানে বোবা। তাড়াতাড়ি করে আমরা মেয়েটিকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসছিলাম। এমন সময় একটা মাইকের আওয়াজ শুনতে পেলাম। এই গহীন জঙ্গলে মাইকের আওয়াজ আসলো কোথা থেকে। সন্ত্রাসীরা আরার ফিরে এলো নাতো। কিন্তু দেখলাম মাইকে বলা হচ্ছে পালানোর চেষ্টা করে কোনো লাভ হবে না। পুরো বাড়ি ঘিরে নেওয়া হয়েছে। বাহিরে এসে আমরা যা দেখলাম তা আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না। পুরো বাড়িটি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। তখন মেয়েটি নাইমের কোলে। পুলিশ আমাদের সন্ত্রাসী ভেবে আটক করে ফেললো। কোনো ভাবেই তাদের বোঝাতে পারলাম না আমরা আসল সন্ত্রাসী না। মেয়েটিও কথা বলতে পারে না। সে যে কিছু বলবে তাও হলো না। আসলে সন্ত্রাসীরা পুলিশের আসার খবর পেয়ে মেয়েটিকে ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছে। আজ জেলে বসে এসব কথা লিখছি। আসলে মানুষ বাহ্যিক দৃষ্টিতে যা দেখে তাই বিশ্বাস করে। হতে এসেছিলাম নায়ক কিন্তু হয়ে গেলাম খলনায়ক। এতকিছুর পরও একটি বিষয়ে ভালো লাগছে মেয়েটি বেঁচে আছে।
মোঃ আসিফ
ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশক : মোহাম্মদ বদরুজ্জামান তালুকদার
সম্পাদক : খান মোহাম্মদ সালেক
Copyright © 2025 Daily Dhaka Press. All rights reserved.