Site icon Daily Dhaka Press

দুবাইয়ের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিস্ময়কর শৃংখলা

খান মোহাম্মদ সালেক, দুবাই থেকে ফিরে : সকাল ৮টা। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক নগরী দুবাইয়ের আল নাহদা (দ্বিতীয়) এলাকা। আবাসিক এলাকা হওয়ায় সকালটা বেশ ব্যস্ত সময়।

কেউ অফিসে ছুটছেন, কেউ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়মুখি কেউ কেউ, কেউ বা অন্য কাজে। নিজ গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছেন অনেকে, বাসের দিকে ছুটছেন একটা অংশ, আবার মেট্রোরেলের পিছুও নিচ্ছেন কিছু মানুষ।

আমার গন্তব্য দুবাই পাবলিক পার্ক। সেখানে কিছুটা সময় হেঁটে সকালের নাস্তা করার পরিকল্পনা। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন আমার এই সফরটি ছিল একান্তই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক।

রাস্তা পার হতে গিয়েই একটু হোঁচট খেলাম। মানুষ এদিক সেদিক না তাকিয়েই রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছেন। আর যানবাহনগুলো থেমে যাচ্ছে পথচারিদের দেখে। আবাসিক এলাকা হওয়ায় পথচারিরা কিন্তু জেব্রা ক্রসিং আছে কিনা সেটাও দেখে রাস্তা পার হচ্ছেন না।

তার সুবিধামত জায়গা দিয়েই তিনি রাস্তা পার হচ্ছেন। আর এই ব্যস্ত সময়েও যতক্ষণ রাস্তায় পথচারি আছেন ততক্ষণ পর্যন্ত গাড়িগুলো দাড়িয়ে থাকছে।

কিছুক্ষণ পরই একটি হলুদ বাস চোখে পড়লো। বাসটিতে লেখা স্কুল বাস, তার পাশেই লেখা ‘স্টপ’। আমাদের দেশে সাধারণত গাড়ির পেছনে লেখা থাকে স্টপ বা থামুন। পাশে এমন লেখা দেখে স্বাভাবিকভাবেই আমার একটু কৌতুহল জাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটি থামলো।

আর স্টপ লেখাটি ছড়িয়ে পড়লো। সাথে সাথে ওই বাসের পেছনের সব গাড়ি থেমে গেল। একজন সুপারভাইজার বাস থেকে নেমে রাস্তার পাশেই বাড়ির সামনে অপেক্ষমান একজন ছাত্রকে নিয়ে বাসে উঠলেন। এরপর স্টপ লেখাটি গাড়ির শরীরের সাথে লেগে গেল এবং বাসটি আবার চলতে শুরু করলো।

ততক্ষণ পর্যন্ত বাসের পেছনের সবগুলো গাড়িই থেমে রইলো। এখানে আরও লক্ষণীয়, দুবাই নগরীতে স্কুল বাসগুলো প্রত্যেকটি বাড়ির সামনে থেকেই শিক্ষার্থীদের বাসে তুলে নেয়। একটা প্রশ্ন জাগতে পারে, বাড়ির সামনের গলি পথে বাস ঢুকবে কিভাবে? জবাবটা খুবই সহজ, আমার দেখা এখানকার গলি পথও চার কিংবা ছয় লেনের হয়ে থাকে।

একটি ব্যস্ত বাণিজ্যিক নগরীর এমন ট্রাফিক ব্যবস্থা আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হলেও এই বাস্তবতা আমাকে নাড়া দিলো। আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম ওই মহল্লার ছোট্ট পার্কটিতে।

আমিরাতিদের ভাষায় ছোট্ট পার্ক হলেও দুবাই পাবলিক পার্কটি বেশ বড়। মরুভূমির এই পার্কটিতে ঢুকেই চোখে পড়লো বাংলাদেশের নিম গাছ এবং ঘাস। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ থেকে উপহার হিসেবে যে নিম গাছ, ঘাস ও গাঁদা ফুল গাছ দেয়া হয়েছিল তা এখন ওরাই চাষ করে সারা দুবাইতে ছড়িয়ে দিয়েছে।

পার্কে রয়েছে পিচঢালা পথ সাইকেল চালানোর জন্য। পাশ দিয়ে চলে গেছে লাল পথ যা নরম করে বানানো। এই পথটি পায়ে হাঁটার জন্য। আর পার্ক জুড়ে রয়েছে খেজুর গাছসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা নানা প্রজাতির ফুল ও অন্যান্য গাছ।

যারা এখানে হাঁটতে আসেন তাদের বিশ্রামের জন্য কিছুক্ষণ পরপরই বসার ব্যবস্থা ছাড়াও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শিশুদের নানা রাইড, বড়দের ব্যায়ামের নানা আয়োজন। এক পাশে বিশাল জলাশয়।

পার্কে কেউ হাঁটছেন, কেউ সাইক্লিং করছেন, কেউ ব্যায়াম করছেন, শিশুরা নানা রাইডে খেলছে, অনেকে বসে আড্ডা দিচ্ছেন কিংবা প্রকৃতি আর আধুনিক নগরায়নের সংমিশ্রণে মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছেন।

প্রয়োজনে হাত-মুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে নিচ্ছেন অনেকে। কিছুক্ষণ পর পরই রয়েছে পানির ব্যবস্থা। আর পাবলিক টয়লেটও রয়েছে পর্যাপ্ত এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

পার্ক থেকে বেরিয়ে পার্কের সাথেই লাগোয়া একটি রেষ্টুরেন্টে নাস্তা করছিলাম আর রাস্তার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দেখছিলাম। দুবাই নগরীর অনেক জায়গায়ই রেস্টুরেন্টযুক্ত রাস্তার পাশে খোলা জায়গা রয়েছে যা রেষ্টুরেন্টের অংশ এবং সেখানেও অনেকেই খাবার খেয়ে থাকেন।

ওখান থেকে মহল্লারই ওদের ভাষায় একটি ছোট্ট হাইপার মার্কেটে চলে গেলাম। ছোট্ট বলা হলেও বিশাল একটি মার্কেট এবং সত্যিকার অর্থেই এক ছাদের নীচে সব ধরণের পণ্যের সমাহার ঘটেছে এখানে।

মার্কেট থেকে বের হওয়ার পথে দেখা গেল ২৫০ মিলি লিটারের প্রচুর পানির বোতল। ক্রেতারা যাদের তৃষ্ণা পেয়েছে তারা ওই পানি নিয়ে নিচ্ছেন। আর এক পাশে চিপস রাখা আছে, যা প্রয়োজনে অনেকেই মুখে দিচ্ছেন।

বিকেলে রওনা হলাম দুবাই ডাউন টাউনের দিকে যেখানে দুবাই মল, বুর্জ খলিফাসহ বহু আকাশচুম্বি অট্টালিকার অবস্থান। কিন্তু যাওয়ার পথে আধুনিক নগরীর অবাক করা সব দৃশ্য দেখার চেয়েও আমি উপভোগ করছিলাম দুবাইয়ের আকাশ।

মেঘ আর সুর্যের মনোমুগ্ধকর লুকোচুরি আমার চোখ আটকে দেয়। মেঘ আর সুর্য যেন প্রতি মুহূর্তে তার রূপ বদলাচ্ছে। মনে হচ্ছিল সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত কি অপরূপ করে সাঁজিয়েছেন। আধুনিক নগরী আর প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম ব্যস্ততম দুবাই মল এলাকায়।

শুরুতে যে ট্রাফিক ব্যবস্থার কথা বলেছিলাম তাতে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্ন জাগতে পারে নগরজুড়েই কি মানুষ ইচ্ছেমত চলবে আর গাড়িগুলো থেমে যাবে? ব্যস্ততম দুবাই মল এলাকাসহ দুবাইয়ের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ হয়ে থাকে।

ব্যস্ত এলাকায় পথচারি পারাপারের জন্য সবুজ বাতি জ¦ললেই শুধু একজন পথচারি রাস্তা পার হবেন। তবে যদি কেউ ভুলক্রমে রাস্তা পার হতে শুরু করেন তাহলেও গাড়িগুলো থেমে যাবে।

তবে ওই পথচারির ছবি রেকর্ড হয়ে যাবে এবং তার জরিমানাও হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। এখানে সাধারণত পোশাকি পুলিশ দেখা যায় না।

সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা হয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে। তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় টহল পুলিশের গাড়ি চোখে পড়ে।

(চলবে)

Exit mobile version