
খান মোহাম্মদ সালেক, দুবাই থেকে ফিরে
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

-সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক নগরী দুবাইয়ের জাবিল পার্ক এলাকায় ঠিক যেন আকাশচুম্বী এক বিশাল ফটো ফ্রেম দাড়িয়ে আছে। ফটো ফ্রেমের মত দেখা গেলেও এটি একটি ওয়াচ টাওয়ার যা দুবাই ফ্রেম নামে পরিচিত।
কাঁচ, ষ্টিল, এলুমিনিয়াম ও রিএনফোর্সড কংক্রিট দিয়ে তৈরি এই দুবাই ফ্রেম ১৫০ মিটার উঁচু দু’টি ফ্রেম দিয়ে তৈরি। একটি কাচের সেতুর মাধ্যমে ফ্রেম দু’টিকে সংযুক্ত করা হয়েছে।
এই কাচের সেতু বা ডেক থেকে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুবাইয়ের পরিকল্পনা দেখার সুযোগ রয়েছে। গোটা নগরীর প্যানোরামিক ভিউ পাওয়া যায় এখান থেকে।
আর এই স্বপ্ননগরী দেখার জন্য দুবাই ফ্রেম দেশী বিদেশী পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত এটি দর্শণার্থীদের জন্য খোলা থাকে। আকাশচুম্বী এই টাওয়ারটি এরই মধ্যে ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডস রেকর্ডসে’ স্থান করে নিয়েছে।
সকালে আমি যখন দুবাই ফ্রেমে পৌঁছলাম তখন টিকিট সংগ্রহের জন্য প্রায় দুই ডজন লোক লাইনে দাঁড়ানো দাড়ানো ছিলেন। মূল ফ্রেমের চারদিক সবুজ ঘাস, নানা প্রজাতির গাছ ও রংবেরং-এর ফুলে সজ্জিত।
রয়েছে ফোয়ারা যার আশপাশ দিয়ে মানুষ আড্ডা দিচ্ছেন, ছবি তুলছেন। টিকিট সংগ্রহ করে ভেতরে প্রবেশ করতেই একজন প্রেজেন্টার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে জানালেন, এখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুবাই দেখা যাবে।
ঠিক তাই, নীচতলা জুড়ে আমিরাতিদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য নানা সামগ্রী সাজিয়ে রাখা হয়েছে। আর ভিডিও চিত্রে দেখানো হচ্ছে অতীত জীবনাচারের নানা দৃশ্য।
বাজার-ঘাট, মাছ ধরা, সুঁই সুতায় কাপড় সেলাই, সেলাই মেশিনে কাপড় সেলাই, রান্নার পদ্ধতি, মাটির হাড়ি-পাতিল তৈরি, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানসহ অতীত দুবাইয়ের নানা ভিডিও চিত্র রয়েছে এখানে।
অতীত অভিজ্ঞতার পরই লিফটে চলে গেলাম সুউচ্চ ভবনের সর্বোচ্চ তলায় অর্থাৎ ১৫০ মিটার উঁচুতে।
ওখানে প্রবেশ করতেই একজন প্রেজেন্টার জানালেন, এখান থেকে সামনের দিকে যেতে বাম দিকে দেখা যাবে পুরনো দুবাই। এখানকার অধিকাংশ ভবনই দেড়শ’ থেকে দু’শ’ বছরের পুরনো।
এর চেয়েও পুরনো ভবন আছে। আবার কিছু ভবন আছে ৫০ বছরের পুরনো। ৮৯৯ সালের একটি ভবন আছে বলেও জানানো হলো।
স্বচ্ছ কাঁচের ডেক দিয়ে নীচ দিকে তাকালে দেখা যাবে দুবাই শহরের মধ্যে অত্যাধুনিক শহরের প্রতীক।
শুরুতে একজন প্রেজেন্টার বিস্তারিত জানালেও এই ডেকে রয়েছেন আরও কয়েকজন গাইড যারা কেউ কিছু জানতে চাইলে তাদের বিস্তারিত জানাচ্ছেন।
বাম দিকে তাকিয়ে দেখা গেল প্রাচীন অথচ সমৃদ্ধ শহরের প্রতীক।
বহু দূরে দেখা গেলো এক তলা, দোতলা, তিন তলা ভবন যার অধিকাংশই সমুদ্রের প্রবাল পাথর আর চুন দিয়ে তৈরি।
পাশেই সমুদ্র। কিছুটা কাছে দেখা গেল চার তলা পাঁচতলা ভবন। কিছু হাইরাইজ বিল্ডিংও দেখা গেল। এসব ভবন বেশ আধুনিক এবং এগুলো ৫০ থেকে ৬০ বছরের পুরনো।
জানা গেল, এসব ভবন ভেঙ্গে অত্যাধুনিক ভবন নির্মাণ নিয়ে মিশ্র ভাবনা রয়েছে। অনেকের মতে ঐতিহ্যের প্রতীক এসব ভবন সংরক্ষণ করা প্রয়োজন।
আবার কারো মতে দুবাই যেভাবে দ্রুত গতিতে আধুনিক হচ্ছে তাতে একদিন এগুলো ভেঙ্গে ফেলতেই হবে। তবে দেড়শ’-দু’শ’ বছরের পুরনো ভবনগুলো সংরক্ষণের ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই।
ডান দিকে তাঁকাতেই দেখা গেল বর্তমান বিশে^র সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ খলিফাসহ অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন আধুনিক হাইরাইজ বিল্ডিং। এসব ভবন স্থাপত্যশৈলীতে উজ্জল। সেই সাথে অত্যাধুনিক নগরীর নানা উপাদান। পরিকল্পিত সড়ক, আইল্যান্ড, সড়ক দ্বীপ, ফোয়ারা, সমুদ্র কেটে এনে তৈরি হ্রদ, সবুজ গাছ, ঘাস আর রংবেরং-এর ফুলের সমাহার নগরী জুড়ে। এই অংশ দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায় একটি মরুভূমির দেশে অত্যাধুনিক নগরায়নের জন্য কত সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক নগরী দুবাই কর্তৃপক্ষ।
এখান থেকেই নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা দেখে যে কেউ অভিভূত হবেন। কোন পোষাকী পুলিশ নেই অথচ কত সুশৃংখলভাবে হাজার হাজার যানবাহন চলছে।
পাবলিক বাস, স্কুল বাস, জীপ, কার কোনটিই ভুলেও লেন পরিবর্তন করছে না। স্কুলবাসগুলো কোন শিক্ষার্থীকে তোলার জন্য থেমে গেলে তার পেছনের সব গাড়িই থেমে যাচ্ছে।
ব্যস্ততার মধ্যেও কেউ সামান্য সমস্যা তৈরি করছেন না। মেট্রোরেল চলছে আপন গতিতে। দুবাই ফ্রেম থেকে প্রাচীন ও অত্যাধুনিক দুবাই নগরী দেখে লিফটে নীচ তলায় নামার পর দেখানো হলো ভবিষ্যৎ দুবাইয়ের ভিডিও চিত্র।
এই চিত্র দেখে মনে হয় এক স্বপ্ন নগরী। স্বপ্নের মত ভবন, থিম পার্ক, সড়ক, ফ্লাইং কার আরও কত কি! ভিডিও চিত্রের সাথে একটি বাক্য বারে বারে দেখানো হচ্ছিল, ‘ভবিষ্যৎ তাদের জন্যই যারা সাহস নিয়ে স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের সাহসী মনোবল রয়েছে।’
এক মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন দুবাই ফ্রেম থেকে বের হলাম তখন দেখি টিকিটের জন্য বিশাল লাইন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এখানে দর্শণার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
প্রায় ২০০ দেশের মানুষ এখানে বসবাস করেন। সব দেশের মানুষই দুবাই ফ্রেম থেকে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুবাইয়ের পরিকল্পনা দেখে মুগ্ধ মনে ঘরে ফিরেন। (চলবে)