খান মোহাম্মদ সালেক, দুবাই থেকে ফিরে-
সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক নগরী দুবাইয়ের ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার জন্য দুই শতাব্দীর প্রাচীন দেইরা এলাকা ঘুরে আসা প্রয়োজন। দুবাইয়ের অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা এটি যেখানে পুরনো দোকান পাটের পাশাপাশি রয়েছে অনেক আধুনিক দোকান ও শো রুম। নগরীর উত্তর-পূর্বে সমুদ্রের তীর ঘেষে গড়ে ওঠা এই বাণিজ্য কেন্দ্রের পাশ দিয়ে একটি বিশাল জলপথ রয়েছে যা সমুদ্র থেকে কেটে নদীর মত তৈরি করা হয়েছে।
এই জলপথে বিশাল বিশাল জাহাজ ছাড়াও রয়েছে নানা ধরণের নৌযান, আছে ছোট ছোট নৌকাও। এখানে প্রচুর কবুতর উড়ে বেড়াচ্ছে, কোথাও কোথাও কবুতরের দল জড়ো হয়ে খড় কুটো খাচ্ছে।
ছোট নৌকাগুলোতে টিকিট কেটে নদী পারি দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। দুবাইয়ের সব জায়গায় কার্ড পদ্ধতি চালু থাকলেও এখানে দেখলাম টিকিট পদ্ধতি। আর ছোট নৌকাগুলো চালানোর জন্য রয়েছেন অনেক বাংলাদেশী। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানুষ নৌকায় ঘুরে বেড়ান এবং মনোরম দৃশ্য উপভোগ করেন।
আমরা নদী পার হয়ে দেইরা এলাকায় পৌঁছে হাঁটতে হাঁটতে অনেক প্রাচীন ভবন ও ছোট ছোট দোকানের দেখা পেলাম। ভবনগুলো এমনভাবে তৈরি যাতে প্রচন্ড গরমেও ভেতরে কিছুটা ঠান্ডা বাতাস প্রবেশ করে। আর ছোট ছোট দোকানগুলোতে রয়েছে আমিরাতীদের ঐতিহ্যবাহী নানা ব্যবহার্য পণ্য। এখানে পণ্যের দামও তুলনামূলক কম।

হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়লো ‘স্পাইস সৌক’ বা মসলা বাজার লেখা বিশাল সাইন বোর্ড। স্পাইস সৌকে ঢুকতেই নানা মসলার সুবাসে নাক ভরে গেলে। এখানকার দোকানগুলো বিশে^র বিভিন্ন দেশের হরেক রকম মসলায় ঠাসা।
দোকানগুলোতে রংবেরং-এর অনেক মসলা দেখা গেল যা বাংলাদেশে সচরাচর দেখা যায় না। দোকানীরা ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী নানা ধরণের মসলা হাজির করছেন যার সবগুলোতেই লেখা রয়েছে মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ। ক্রেতারা পছন্দের মসলা নিয়ে নিচ্ছেন আর যাবার সময় দোকানী ধরিয়ে দিচ্ছেন উপহার হিসেবে আরও কিছু মসলা।
এই স্পাইস সৌকেই পাওয়া গেল এরাবিয়ান চাসহ নানা ধরণের চা, ফ্লাওয়ার চা, মসলা চা, গাওয়া ও বিশে^র সেরা ব্র্যান্ডের নানা রকম কফি। এখানকার চায়ের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ¯^াদ যা দেশী বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। দোকানীরা জানালেন, এসব চায়ের মধ্যে কোনটি ক্লান্তি দূর করে, কোনটি মনকে সতেজ করে, কোনটি প্রশান্তি এনে দেয়, কোনটি বা রাতে ঘুমে সহায়ক হয়। কফিরও রয়েছে রকমভেদ এবং এগুলোরও রয়েছে নানা গুণ।
স্পাইস সৌক থেকে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশাল ‘গোল্ড সৌক’ বা ¯^র্ণ বাজারে ঢুকে অভিভূত হলাম। এই বাজারে প্রবেশের জন্য রয়েছে একাধিক গেট এবং প্রশস্ত রাস্তার দু’ধারে দোকান বা শো রুমের অবস্থান। এখানে রয়েছে বড় বড় সব শো রুম যেখানে বিভিন্ন দেশের মানুষের পছন্দের অলংকার সাঁজিয়ে রাখা হয়েছে। অপূর্ব কারুকাজের এসব অলংকার দেখে যেকোন ক্রেতাই অলংকারের প্রতি আগ্রহী হবেন।
মাথা থেকে পা পর্যন্ত শরীরের নানা অঙ্গের অলংকার রয়েছে এখানে। আবার পুরো শরীর আবৃত করে রাখার মত ¯^র্ণালংকারও পাওয়া যায়। এখানে শুধু নানা ডিজাইনের অলংকারই নয়, শো রুমগুলোর ইন্টেরিয়রের অনেক কিছুই করা হয়েছে ¯^র্ণ দিয়ে। ক্রেতাদের আগ্রহী করার জন্য শো রুমগুলোর সামনে দেখানো হচ্ছে বিভিন্ন অলংকারের ভিডিও চিত্র। আর ক্রেতাদের ধরে রাখার জন্য বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছেন তরুণীরা। ব্যয়বহুল এই ¯^র্ণ বাজারে কিন্তু ক্রেতাদের প্রচন্ড ভীড় এবং ¯^র্ণালংকার বিক্রিও হচ্ছে বেশ।
গোল্ড সৌক ছাড়াও এখানে রয়েছে ‘পারফিউম সৌক’ যা আরও একটি আকর্ষণীয় বাজার। এখানে বিশে^র নামি দামি ব্র্যান্ডের প্রসাধন সামগ্রীর সমাহার ঘটেছে। দোকানীরা বিনয়ের সাথে ক্রেতাদের সামনে বিভিন্ন ধরণের পারফিউম হাজির করছেন, উপহার হিসেবে দিয়ে দিচ্ছেন মিনিপ্যাক। বিশেষ করে নতুন কোন পারফিউম এলে তা তুলে ধরছেন। ক্রেতারা আসছেন, দেখছেন আর পছন্দনীয় পারফিউম কিনে চলে যাচ্ছেন।
দেইরা এলাকাতেই রয়েছে ‘গ্র্যান্ড সৌক দেইরা’ যেখানে পাওয়া গেল ঐতিহ্যবাহী এরাবিয়ান সব উপহার সামগ্রী। অনেক বিদেশী নাগরিক বিশেষ করে পর্যটকরা এই বাজারে ভীড় করছেন বেশী। তারা ঐতিহ্যবাহী এরাবিয়ান পণ্য খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছেন এবং পছন্দের সামগ্রী কিনে নিচ্ছেন প্রিয়জনকে উপহার দেয়ার জন্য।
এখানেই রয়েছে দেইরা ওয়াটার ফ্রন্ট মার্কেট যেখানে রয়েছে সীফুডের বহু দোকান। এসব দোকানেও কিন্তু মানুষের ভীড় অনেক। ‘সৌক আল মারফা’য় রয়েছে শত শত খুচরা পণ্যের দোকান।
এমনই নানা পণ্যের বাজার ঘুরে বেরিয়ে এলাম এবং নৌপথের তীরে এসে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে পুরো নৌপথ ও আশপাশের এলাকার রূপ বদলে গেছে। রাতের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে পুরো এলাকা। বিশাল জাহাজগুলো আলো ঝলমল করছে, ছোট ছোট নৌকাও আলোকিত। আর এই নৌপথের তীরে তখন হাজারো মানুষ।
কেউ আড্ডা দিচ্ছেন, কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কেউ নৌকায় চরে নৌপথে ঘুরছেন। সবারই লক্ষ্য দুই শতাব্দীর প্রাচীন দুবাইয়ের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা। মধ্যরাত পর্যন্তই এখানে থাকে দর্শণার্থীদের ভীড়। (চলবে)