খান মোহাম্মদ সালেক, দুবাই থেকে ফিরে -
সংযুক্ত আরব আমিরাত সফরকালে বেশ কিছু রেস্টুরেন্টে খাবার গ্রহণের সুযোগ হয়েছে আমাদের। আমিরাতী রেস্তোরার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ছাড়াও আমাদের এই অ লের খাবারের রেস্টুরেন্টও রয়েছে আমিরাত জুড়ে। সব রেস্টুরেন্টই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশন করছে। রেস্টুরেন্টের পরিবেশও অনেক সুন্দর যা দেখেই ভাল লাগে। জানতে ইচ্ছা হলো এখানকার রেস্তোরা ব্যবসায় কী কী নিয়ম মেনে চলতে হয়।
[caption id="attachment_15495" align="alignnone" width="300"]
আমিরাতে পে ক্যাফে বা ক্যাফেটারিয়া রয়েছে যেখানে বসার ব্যবস্থা রয়েছে কম। এখানে মানুষ সাধারণত ব্যস্ততার মাঝে চলার পথে গাড়ি থামিয়ে প্যাকেট খাবার সংগ্রহ করে চলে যান। আর রয়েছে সিটিং রেস্টুরেন্ট যেখানে মানুষ বসে স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করেন। স্বাভাবিকভাবেই রেস্টুরেন্টের জন্য মিউনিসিপ্যালিটির ট্রেড লাইসেন্স করার প্রয়োজন রয়েছে। রেস্টুরেন্টের ডিজাইন অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা সন্তোষজনক কিনা তার জন্য প্রয়োজন হয় সিভিল ডিফেন্সের অনুমোদন।
একটি রেস্তোরার ডিজাইন করার সময় পুরো রেস্তোরার ৬০ শতাংশ হতে হয় কিচেন বা রান্নার জায়গা। সেখানে চুলা নিরাপদ ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে স্থাপন করা হয়েছে কিনা তা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বেশিন, সিংকের অবস্থান, হাড়ি-পাতিল, তৈজষপত্র ধোয়ার ব্যবস্থা এবং সেগুলো কোথায় কিভাবে রাখা হচ্ছে, রান্না ঘরে পর্যাপ্ত বাতাস নির্গমণের ব্যবস্থা আছে কিনা, আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রুত তা মোকাবেলার কি ব্যবস্থা তা নিশ্চিত করতে হয় রেস্টুরেন্ট চালু হওয়ার আগেই।
[caption id="attachment_15496" align="alignnone" width="300"]
অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য সিভিল ডিফেন্স বিভাগের বিশেষজ্ঞ দল নানাভাবে রেস্টুরেন্টের পুরো ব্যবস্থাপনা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে নেন। আগুন লাগলে মানুষ কিভাবে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে পারেন এবং কোন ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া কিভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সে বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হয়। তারপরই অনুমোদনপত্র দেয় সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ। অগ্নিনির্বাপন নিয়ে রেস্টুরেন্টের কর্মীদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন সময় মহড়ারও আয়োজন করা হয়।
এরপর আসে গ্রাহকদের বসে খাবার গ্রহণের বিষয়টি। রেস্টুরেন্টের পুরো জায়গার ৪০ শতাংশ বরাদ্দ হয় ডাইনিং বা খাবার পরিবেশনের জন্য। এখানেও বসার ব্যবস্থা কতটা স্বস্তিদায়ক তা নিশ্চিত করতে হয়। পর্যাপ্ত জায়গা নিয়ে গ্রাহকদের হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, খাবার পানির বোতল ছাড়াও বিশুদ্ধ খাবার পানি নিশ্চিত করতে হয় এখানে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়।
কিছু রেস্টুরেন্ট তাদের সম্প্রসারিত অংশে বসার ব্যবস্থা করে যা রেস্টুরেন্টের সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে। এর জন্য অনুমোদন দেয় সড়ক ও পরিবহন বিভাগ। ভোর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে রেস্টুরেন্ট। কিছু রেস্টুরেন্ট ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে যার জন্য যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখিয়ে অনুমোদন নিতে হয়।
আর রেস্টুরেন্টের ভেতরে বাইরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন বাধ্যতামূলক। রেস্টুরেন্টের ভেতরে আনাচে কানাচে কোন ঘটনা ঘটলে তা সিসিটিভি ক্যামেরা থেকে নিশ্চিত হওয়ার ব্যবস্থা করতে হয় রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষকেই। আর রেস্টুরেন্টের বাইরের রাস্তা এবং আশপাশের এলাকার দৃশ্যও সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনতে হয়।
সংযুক্ত আমিরাতে একটি রেস্তোরার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহের পুরো অনুমোদন পেতে ছয় মাস কিংবা তারও বেশী সময় লেগে যায়। স্বাভাবিকভাবেই পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, দেশটিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অনেক বেশী কিনা। বিষয়টি তা নয়, প্রত্যেকটি শর্ত পুরণ হচ্ছে কিনা তা যাচাই বাছাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর বিশেষজ্ঞরা সশরীরে রেস্টুরেন্ট পরিদর্শন করেন। কোন শর্তে সামান্য ব্যত্যয় ঘটলে তা ভেঙ্গে নতুন করে তৈরি করতে হয়। সব শর্ত নিখুঁতভাবে পুরণ হলেই চালু হতে পারে একটি রেস্টুরেন্ট।
একটি রেস্টুরেন্ট চালু হওয়ার পর মানুষ কোন রকম আতংক ছাড়াই নিরাপদে খাবার গ্রহণ করছেন। এখানে কোন রকম অনিয়ম হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য আকস্মিক পরিদর্শনে চলে যান সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিশেষজ্ঞরা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় কোন ত্রুটি পেলেই জরিমানা করা হয় মোটা অংকের। কোন পোকা মাকড় দেখা গেলে এক সপ্তাহের জন্য রেস্টুরেন্টটি সীল গালা করে দেয়া হয় আর সুযোগ দেয়া হয় জীবাণুমুক্ত করার।
এসময়ের মধ্যে জীবাণুমুক্ত করতে না পারলে ওই রেস্টুরেন্টটি আর চালু হতে পারে না। আর বাসি পচা খাবার পাওয়া গেলে চিরদিনের জন্য সীল গালা করে দেয়া হয় আমিরাতের যেকোন রেস্টুরেন্ট।
সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর বিশেষজ্ঞ দলের আকস্মিক পরিদর্শন ছাড়াও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ ও পর্যটন বিভাগের একটি অভিযোগ সেল রয়েছে যেখানে মানুষ ২৪ ঘন্টাই টেলিফোনে অভিযোগ করতে পারেন। আর কর্তৃপক্ষও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তবে রেস্টুরেন্ট নিয়ে কোন অভিযোগের ঘটনা সংযুক্ত আরব আমিরাতে নেই বললেই চলে। অগ্নি দুর্ঘটনার তথ্যও কেউ দিতে পারেননি।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘুরে দেশে ফেরার কিছুদিন পরই রাজধানীর বেইলি রোডে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে অগ্নিকান্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর ঘটনায় বার বার মনে পড়ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের কথা। দেশটি তার স্বাধীনতার ৫২ বছর পর রেস্টুরেন্ট চালুর ক্ষেত্রে মানুষের নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করার জন্য কি অনুসরণীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। আর আমাদের স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি।
এক একটি দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা তোলপাড় শুরু করে দেই। তদন্ত কমিটি গঠন করে ত্রুটি বের করি এবং নানা পদক্ষেপের সুপারিশ করি। কিন্তু সেসব সুপারিশ আর বাস্তবায়ন হয় না। এই সুযোগে এক শ্রেণীর মানুষ অবৈধভাবে নানা স্থাপনা তৈরি করে ব্যবসা চালিয়ে যেতে থাকেন।
হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গী হামলার ঘটনায় দেশ-বিদেশে তোলপাড় হলেও পরবর্তিতে জানা যায়, ওই ভবনে রেস্টুরেন্টের অনুমোদন ছিল না।
তখনই তৎপরতা শুরু হয়ে যায় আবাসিক এলাকার সব রেস্টুরেন্ট তুলে দেয়ার জন্য। কিন্তু সেই তৎপরতাও বেশীদিন টিকেনি। ফলে রাজধানীর সব আবাসিক এলাকায় জমজমাট রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় কেমিক্যাল বিস্ফোরণে ৭৮ জনের মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষ বেশ তৎপর হয়ে উঠেছিল। ওই বিস্ফোরণ ঘটেছিল আবাসিক ভবনে অবৈধভাবে রাখা কেমিক্যাল থেকে। তখন রাজধানীর অগ্নিকান্ডের অন্যতম কারণ অবৈধ কেমিক্যালকে চিহ্নিত করে কেমিক্যাল সরানোর তৎপরতা শুরু হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। আর অবৈধ ব্যবসায়ীরা নতুন উদ্যমে কেমিক্যালের ব্যবসা বাড়িয়ে দেন।
২০১০ সালের পুরনো ঢাকার নিমতলিতেও কেমিক্যালের আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষ আবার নড়ে চড়ে বসেছিল। অবৈধ কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে ফেলার অভিযান ছাড়াও তদন্ত কমিটির ১৭টি সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। অবৈধ ব্যবসায়ীদের সাহস যেন আরও বেড়ে যায় এবং তাদের অবৈধ ব্যবসাও চলমান থাকে।
২০১২ সালে তাজরিন গার্মেন্টসে আগুনে ১১১ জনের মৃত্যুর পর জানা যায় জরুরী নির্গমণ এবং অগ্নিনির্বাপণের পর্যপ্ত ব্যবস্থা সেই ভবনে ছিল না। এই ঘটনা শুধু দেশেই নয়, বিদেশে ক্রেতা কোম্পানীগুলোকেও নাড়া দেয় এবং বাংলাদেশের পোশাক আমদানীকারকরাও নানা শর্ত দিতে থাকে। তখন শুরু হয়ে যায় পোশাক কারখানায় জরুরী নির্গমন ও অগ্নিনির্বাপনের জন্য নানা উদ্যোগ। কয়েকদিন হৈচৈয়ের পর আবার তা থেমে যায়।
২০২০ সালে নারায়নগঞ্জের ফতুল্লায় বাইতুস সালাত জামে মসজিদে অগ্নিকান্ডে ৩৪ জনের মৃত্যুর পর শুধু তদন্ত কমিটিই নয়, গ্যাস লাইনে ত্রুটি থাকার কারণে তিতাস গ্যাসের কর্মকর্তা-কর্মচারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। তোড়জোর শুরু হয়ে যায় গ্যাস লাইনের ত্রুটি নিয়ে। ২০১৬ সালে টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীতে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্যাকেজিং কারখানায় অগ্নিকান্ডে ২৪ জনের মৃত্যুর পর প্রথমে বয়লার বিস্ফোরণে অগ্নিকান্ডের ধারণা করা হলেও তদন্তে ধরা পড়ে গ্যাস লাইনের ত্রুটি থেকে এই অগ্নিকান্ড। তখনও গ্যাস লাইনের ত্রুটি দূর করার জন্য একটা তৎপরতা শুরু হলেও তা এক সময় থেমে যায়।
রাজধানীর বেইলি রোডে অনুমোদন এবং অনুমোদনহীন অনেক রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠেছে যেখানে আকর্ষণীয় সব সাইন বোর্ড চোখে পড়ে। এখানে দেশী বিদেশী নানা পদের খাবার পরিবেশন করা হয়। মানুষও ভীড় করেন এখানে ভিন্ন স্বাদের খাবার গ্রহণের জন্য। অগ্নিকান্ডের পরই জানা যায় আটতলা ভবনের সাত তলা পর্যন্ত ১০টি রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
নীচতলায় চা-কফির দোকান চুমুক থেকে আগুনের সূত্রপাত এবং দোতলায় কাচ্চি ভাইয়ে ৫০ শতাংশ ছাড় থাকায় মানুষের ভীড় ছিল। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে, তদন্ত কমিটিও কাজ করছে। চারজনকে এরই মধ্যে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এই দুর্ঘটনা নিয়ে বেশ কয়েকদিন হৈচৈ চলবে। একসময় তাও থেমে যাবে এবং নতুন একটি দুর্ঘটনার পর আমরা হয়তো খুঁজে পাবো দুর্ঘটনার নতুন কোন কারণ। (চলবে)
প্রকাশক : মোহাম্মদ বদরুজ্জামান তালুকদার
সম্পাদক : খান মোহাম্মদ সালেক
Copyright © 2025 Daily Dhaka Press. All rights reserved.