খান মোহাম্মদ সালেক, দুবাই থেকে ফিরে
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই নগরী জুড়ে রয়েছে আকাশচুম্বী আধুনিক অট্টালিকাসহ নানা স্থাপনা। রাতে চোখ ধাঁধানো আলো ঝলমলে হয়ে উঠে এই নগরী। এসব আকাশচুম্বী অট্টালিকার পাশাপাশি আমিরাতের প্রাচীন সভ্যতার চিহ্ন বহন করছে পুরনো দুবাইয়ের দেরা ও বার দুবাই এলাকা। সেই সভ্যতার ইতিহাস জানার জন্য এক বিকেলে চলে গেলাম প্রায় ২৩৭ বছরের পুরনো আল ফাহিদি দূর্গ ঘিরে গড়ে ওঠা দুবাই জাদুঘরে।

মূল জাদুঘরে সংস্কার কাজ চলার কারণে দর্শণার্থীদের জন্য তা বন্ধ থাকায় ভেতরে যাওয়া হলো না। তবে সমুদ্রের প্রবাল পাথর ও চুন দিয়ে ১৭৮৭ সালে নির্মিত এই দূর্গের চারদিকে প্রাচীন কামান, গোলাবারুদ ও নানা রকম সরঞ্জামাদি রয়েছে। রয়েছে ঢাল-তলোয়ারসহ পুরনো সব যুদ্ধাস্ত্র। তেল খনির সন্ধান পাওয়ার আগে আমিরাতী জীবন যাপনের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে এই জাদুঘরকে ঘিরে।
জাদুঘরের আশপাশের বহু প্রাচীন বাড়ি জাদুঘরের আওতায় আনা হয়েছে যেগুলো আমরা খোলা পাই। দেড়শ’ থেকে দু’শ’ বছরের পুরনো এসব বাড়ির দেয়াল সমুদ্রের প্রবাল পাথর দিয়ে তৈরি। অসাধারণ স্থাপত্যশৈলির চিহ্ন রয়েছে এসব বাড়িতে। কয়েকটি বাড়িতে প্রবেশ করলাম। বাড়িগুলোর উঠান বেশ সাজানো, খেজুর গাছ রয়েছে, রয়েছে বসার ব্যবস্থা।
এসব বাড়ির প্রবেশ মুখেই দেখা গেল কিছু ডেকোরেশন পিস যা সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করে। বাড়িতে একাধিক বসার কক্ষ বেশ বড় যেখানে ভিন্ন ধরণের সোফা যা চোখে পড়ার মত। মাঝে টেবিলে সাজানো প্রচীন আমলের নানা সামগ্রী। দেয়ালে পেইন্টিং ও নানা শিল্পকর্ম রয়েছে। প্রাচীন সামগ্রীর মধ্যে আরো রয়েছে হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, হারিকেন, ইস্ত্রি, বদনা, তালা-চাবি ইত্যাদি। অনেক প্রাচীন বাদ্যযন্ত্রও রয়েছে এসব বাড়িতে। রান্না ঘরে পুরনো চুলাও যতœ করে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
এসব বাড়ির আশপাশে ছোট ছোট কিছু কুড়ে ঘরও দেখা গেল। এসব ঘর গাছের ডাল ও খেজুর গাছের পাতা দিয়ে তৈরি। এখানে যে নৌকার ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকেই ছিল তা বোঝা গেল কিছু নৌকা দেখে। সত্তর দশকের একটি বিশাল রেস বোটও দেখা গেল এখানে। দুবাইয়ের সাবেক শাসক মরহুম শেখ মকতুম বিন রশিদ আল মকতুমের এই নৌকাটি চালাতে ৭৮ জন মাঝি ছিলেন। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত এটি নৌকা বাইচে অংশ নিয়েছে এবং বরাবরই জয়ী হয়েছে।
একটি বাড়িতে ঢুকেই চোখে পড়লো বসার ঘরের এক পাশে কিছু বিদেশী দর্শণার্থী বসে আছেন। আর একজন আমিরাতী প্রেজেন্টার তাদের সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দুবাইয়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্রীফ করছেন। আমি এগিয়ে যেতেই আমাকে এরাবিয়ান টি ও স্ন্যাকস দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। তারপর আমিও গিয়ে বসলাম ওই প্রেজেন্টারের সামনে। তিনি জানালেন, ওখানে এক কোটি লোক বসবাস করেন যার নব্বই লাখই বিদেশী। প্রায় দু’শ’ দেশের মানুষের বাস দেশটিতে।
তিনি জানালেন, বিভিন্ন দেশের মানুষ সংস্কৃতির চর্চা করেই বসবাস করছেন দেশটিতে। এখানে বিদেশীদের চাকরির অনেক সুযোগ রয়েছে এবং মেধাবীরা ভাল অবস্থান নিয়ে কাজ করছেন। এসময় তিনি দর্শণার্থীদের নানা প্রশ্নেরও জবাব দেন। পড়ে তিনি সবার সাথে ছবি তোলেন।
সেখান থেকে চলে গেলাম অন্য একটি বাড়িতে। দেড়শ’ বছরের পুরনো বাড়ির বসার কক্ষে প্রবেশ করতেই এরাবিয়ান চা এবং স্ন্যাকস দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। এই বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দোতলা বাড়িটিতে একাধিক বসার ঘর রয়েছে যার প্রাচীন ইন্টেরিয়র বেশ সুন্দর। পুরনো শো পিস এবং অন্যান্য দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিষপত্র দেখে মনে হলো এদের পারিবারিক ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ।
এসব বাড়ি সম্পর্কে আরও জানার আগ্রহ নিয়ে আমি আপ্যায়নকারীকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, তিনি আমিরাতী নন। তবে দর্শণার্থীদের অবহিত করার জন্য আমিরাতী প্রেজেন্টার আছেন। আমি তার সাথে দেখা করতে চাইলে তিনি বললেন, আপনি অতিথি, আপনি বসুন। আমি খবর দিচ্ছি, প্রেজেন্টার চলে আসবেন। এক মিনিটের মধ্যেই শিক্ষিত টগবগে তরুণ হামাদ আল শেজাওয়ি চলে এলেন এবং সালাম দিয়ে বিনয়ের সাথে ¯^াগত জানালেন।
তিনি তাদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথা তুলে ধরে বললেন, দেশটিতে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটলেও নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে অক্ষুন্ন রাখতে তারা সচেষ্ট।
পুরো বাড়িতে কোন শয়ন কক্ষ আমার চোখে না পড়ায় এ ব্যাপারে আমি জানতে চাইলে তিনি বললেন, গরম দেশ, প্রাচীন কালে তাদের আধুনিক কোন ব্যবস্থা ছিল না এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও ছিল না। তাই তারা তাপমাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে কখনো বাড়ির ছাদে, কখনো মেঝেতে, কখনো বা খোলা আকাশের নীচে ঘুমাতেন।
তিনি প্রাচীন ভবনের নির্মাণ শৈলি দেখিয়ে বললেন, এই ব্যবস্থায় ঘরে বাতাস ঢুকে তা নীচের দিকে এসে ঘরকে কিছুটা ঠান্ডা রাখতো। তার সাথে আলোচনা শেষে আমি ছবি তোলার আগ্রহ দেখিয়ে তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনি বিনয়ের সাথে বললেন, আপনি অতিথি, আপনি বসুন, আমি আসছি আপনার কাছে। পরে তিনি আমার পাশে এসে বসলেন এবং ছবি তুললেন।
ওখান থেকে বেরিয়ে দুবাই জাদুঘর ঘিরে দুবাইয়ের এই পুরনো এলাকাটি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এর পাশেই একটি বিনোদন কেন্দ্র আলসীফ দুবাই যা ততক্ষণে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের আলোয় ঝলমল হয়ে উঠেছে। এখানে ছোট্ট একটি মে সঙ্গীত পরিবেশন করছেন শিল্পীরা। আর শত শত মানুষ সঙ্গীতের পাশাপাশি সমুদ্রের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করছেন।
হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়লাম হস্তশিল্পের একটি বাজারে। এখানে আমিরাতের নানা হস্তশিল্প পণ্য ছাড়াও বহু এন্টিকের সমাহার ঘটেছে। মাটির তৈজসপত্র, কাসা-পিতলের নানা সামগ্রী, ঘর সাঁজানোর নানা পণ্যের অনেক কিছুর সাথেই বাংলাদেশের পুরনো ব্যবহার্য সামগ্রীর মিল চোখে পড়লো। (চলবে)