গরমের উৎপাতে দিশেহারা অবস্থা। প্রচণ্ড গরমে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। জারি করা হয়েছে হিট অ্যালার্ট। বিনা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হতে নিষেধ করা হচ্ছে। তবু জীবন আর জীবিকার তাগিদে বাইরে বের হতেই হয়। ঘরেও যে শান্তি তেমনটা নয়। রান্না করতে চুলার সামনে গেলেই যেন গায়ে ফোসকা পড়ছে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান দাবদাহে হিট স্ট্রোক থেকে রক্ষা পেতে সরাসরি সূর্যের আলোতে কাজ না করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) জনস্বাস্থ্য ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান বলেন, 'চিকিৎসা না নিলে হিট স্ট্রোকও ব্রেন স্ট্রোকের মতোই মারাত্মক হতে পারে। বয়স্ক ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে।'
এই অধ্যাপকের ভাষ্য, বাইরে তাপমাত্রা যাই হোক না কেন আমাদের শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাপমাত্রা প্রায় স্থির রাখতে সক্ষম। কিন্তু অতিরিক্ত গরমে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কাজ করা বন্ধ করে দিলে তখন তাকে হিট স্ট্রোক বলা হয়। এর ফলে ঘাম বন্ধ হয়ে গিয়ে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে শুরু করে।
মাত্রাতিরিক্ত গরমে বাড়ছে হিট স্ট্রোকের প্রবণতা। ইতোমধ্যে কয়েকটি জেলায় হিট স্ট্রোক করে প্রাণ হারিয়েছেন কিছু মানুষ। অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না এমনটা হলে কী করবেন?
চলুন জেনে নেই কোন উপায়ে এই সমস্যা প্রতিরোধ করা যায়-
হিট স্ট্রোক কী?
প্রচণ্ড গরম আবহাওয়ায় যদি শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় এবং শরীরের তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায় তখন তাকে হিট স্ট্রোক বলে।
হিট স্ট্রোক এর কারণ কী-
স্বাভাবিক অবস্থায় রক্ত দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। কোনো কারণে যদি শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে ত্বকের রক্তনালী প্রসারিত হয় এবং অতিরিক্ত তাপ পরিবেশে ছড়িয়ে দেয়। প্রয়োজনে ঘামের মাধ্যমেও শরীরের তাপ কমে যায়। কিন্তু প্রচণ্ড গরম ও আর্দ্র পরিবেশে বেশি সময় অবস্থান বা পরিশ্রম করলে তাপ নিয়ন্ত্রণ আর সম্ভব হয় না। ফলে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত বিপদসীমা ছাড়িয়ে যায় এবং হিট স্ট্রোক দেখা দেয়।
হিট স্ট্রোক কেন হয়?
কড়া রোদ ও তীব্র দাবদাহে বেশি সময় ধরে থাকলে হিট স্ট্রোক হয়। এছাড়াও অতিরিক্ত গরমে কায়িক পরিশ্রম, ভারি কাজ, ব্যায়াম করলেও এই সমস্যা হয়ে থাকে। পর্যাপ্ত পানি বা তরল পানীয় পান করলে, শরীর ডিহাইড্রেড হয়ে গেলে, মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করলেও হিট স্ট্রোক হতে পারে। অনেকসময় গরমে বেশি ভারি পোশাক পরলেও এই জটিলতায় পড়তে পারেন।
হিট স্ট্রোক এর লক্ষণ-
হিট স্ট্রোকের কিছু প্রাথমিক লক্ষণ হলো
- মাথা ঝিমঝিম করা
- শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে যাওয়া
- বমি বমি ভাব ও খিচুনি
- মতিভ্রম
- মেজাজ খুব দ্রুত পরিবর্তিত হওয়া
- অবসাদগ্রস্ততা
এছাড়াও হিট স্ট্রোক করলে দেহের তাপমাত্রা দ্রুত ১০৫ ডিগ্রিº ফারেনহাইট ছাড়িয়ে যায়। ঘাম বন্ধ হয়ে ত্বক শুষ্ক ও লালচে হয়ে পড়ে। নিশ্বাস দ্রুত হয়ে যায়। কমে যায় প্রস্রাবের পরিমাণ। রোগী শকে চলে যায়। এমনকি অজ্ঞানও হতে পারে।
হিট স্ট্রোক করলে করনীয়-
কেউ হিট স্ট্রোক করলে দ্রুত তাকে কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া উচিত। বিশেষত হিট স্ট্রোকের আগে যখন হিট ক্র্যাম্প বা হিট এক্সহসশন দেখা দেয়, তখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারলে হিট স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব।
নিজে হিট স্ট্রোক করবেন মনে হলে করণীয়-
দ্রুত শীতল কোনো স্থানে চলে যান। সম্ভব হলে ফ্যান বা এসি ছেড়ে দিন। রাস্তায় থাকলে কোনো শপিংমল বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দোকানে আশ্রয় নিন। ভেজা কাপড় দিয়ে পুরো শরীর মুছে ফেলুন। সম্ভব হলে গোসল করে ফেলুন। প্রচুর পানি ও খাবার স্যালাইন পান করুন। এই অবস্থায় চা বা কফি পান করবেন না। তাহলে শরীর আরও পানিশূন্য হয়ে পড়বে।
কেউ হিটস্ট্রোক করলে করণীয়-
যদি যদি হিট স্ট্রোক করেই ফেলে তাহলে রোগীকে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। ঘরে চিকিৎসা করার কোনো সুযোগ নেই। প্রাথমিক চিকিৎসা হিসেবে যা করতে পারেন-
- রোগীকে দ্রুত শীতল স্থানে নিয়ে যান
- শরীরে কাপড় খুলে দিন বা বাঁধন হালকা করুন
- শরীর পানিতে ভিজিয়ে দিয়ে বাতাস করতে থাকুন, এতে দেহের তাপমাত্রা কমবে
- সম্ভব হলে কাঁধে, বগলে আর কুচকিতে বরফ দিন
- রোগীর যদি জ্ঞান থাকে তাহলে তাকে খাবার স্যালাইন দিন
- দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করুন
- হিট স্ট্রোকে অজ্ঞান রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস এবং নাড়ি চলছে কি না সেদিকে সবসময় নজর রাখুন
- প্রয়োজন হলে কৃত্রিমভাবে নিশ্বাস ও নাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করতে হতে পারে
হিট স্ট্রোক থেকে বাঁচার উপায়-
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে যতটা সম্ভব রোদ এড়িয়ে চলুন। পর্যাপ্ত পানি পান করুন। বাইরে বের হলে পানি, ছাতা, সানগ্লাস, রুমাল ইত্যাদি সঙ্গে রাখুন। সরাসরি রোদের তাপে বেশি সময় থাকবেন না।
হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা-
তীব্র গরম থেকে দূরে থাকুন, মাঝে মাঝে ছায়ায় বিশ্রাম নিন।
প্রচুর পরিমাণে নিরাপদ পানি পান করুন। হেপাটাইটিস এ, ই, ডায়রিয়াসহ প্রাণঘাতি পানিবাহিত রোগ থেকে বাঁচতে রাস্তায় তৈরি পানীয় ও খাবার এড়িয়ে চলুন। প্রয়োজনে একাধিকবার গোসল করুন।
গরম আবহাওয়ায় ঢিলেঢালা পাতলা ও হালকা রঙের পোশাক পরুন, সম্ভব হলে গাঢ় রঙিন পোশাক এড়িয়ে চলুন।
গরম আবহাওয়ায় যদি ঘাম বন্ধ হয়ে যায়, বমি বমি ভাব দেখা দেয়, তীব্র মাথাব্যথা হয়, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, প্রস্রাব কমে যায়, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া হয়, খিঁচুনি ও অজ্ঞান হওয়ার মতো কোনো লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে অবিলম্বে হাসপাতালে যান এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
হিট স্ট্রোক সামান্য স্বাস্থ্য সমস্যা মনে হলেও এর কারণে জীবন বিপদাপন্ন হতে পারে। তাই সতর্ক থাকুন, সুস্থ থাকুন।
ডেইলি ঢাকা প্রেস/রেজাই রাব্বী/২৩ এপ্রিল,২০২৪
প্রকাশক : মোহাম্মদ বদরুজ্জামান তালুকদার
সম্পাদক : খান মোহাম্মদ সালেক
Copyright © 2025 Daily Dhaka Press. All rights reserved.