ভারতে গত দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যকে করায়ত্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি; আর এক্ষেত্রে রণকৌশল হিসেবে রাজ্যের বিধানসভা ও লোকসভা আসনগুলো দখলে বিশেষ মনযোগী দলটির হাইকমান্ড।
তবে বিজেপির গত দেড় যুগের এই নিবিড় প্রচেষ্টায় কাজের কাজ তেমন হচ্ছে না। গত ১০ বছরে রাজ্যে যত নির্বাচন হয়েছে, প্রত্যেকটিতেই ভূমিধস জয়ের ঘোষণা দিয়েছে বিজেপি।
তৃণমূল কংগ্রেসের অধিকাংশ হেভিয়েট প্রার্থী জয় পেয়েছে। মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তর চব্বিশ পরগনায় লাখ লাখ ভোটের ব্যবধানে এগিয়ে জয়ের পথে।লোকসভা নির্বাচনেও এবার মডেল হয়ে উঠল ডায়মন্ড হারবার।
কারণ দুপুর ৩টে বেজে ১০ মিনিটের হিসেবে সেখানে ৭ লক্ষ ১ হাজার ৫৬৩ ভোটে এগিয়ে রয়েছে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, যা চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে প্রয়াত অনিল বিশ্বাসকেও ছাপিয়ে গেলেন অভিষেক।
লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য (এমপি) হলেন ‘বহিরাগত’ তিন তারকা। এ তিন তারকা হলেন বলিউড সুপারস্টার শত্রুঘ্ন সিনহা, ভারতের বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট দলের সাবেক দুই সদস্য কীর্তি আজাদ ও ইউসুফ পাঠান। তারা কেউই পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা না হলেও নির্বাচন করেছেন এ রাজ্যে। তিনজনই ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের খবরে বলা হয়, শত্রুঘ্ন সিনহা ও কীর্তি আজাদ বিহারের বাসিন্দা, আর ইউসুফ পাঠানের বাড়ি গুজরাটে। তারকাখ্যাতির জন্য তাদেরকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন আসনে প্রার্থী করে তৃণমূল।
মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের মতো ‘হেভিওয়েট আসনে’ বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট দলের সদস্য ইউসুফ পাঠানকে প্রার্থী করে চমকই দিয়েছিল তৃণমূল। এ আসনে তার প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি অধীর চৌধুরী। প্রায় ৮৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে অধীরকে হারিয়েছেন ইউসুফ।
২০২২ সালে আসানসোলে উপনির্বাচনে জিতে এমপি হন শত্রুঘ্ন সিনহা। এবারও এ আসনে তাকে প্রার্থী করে তৃণমূল। আর বিজেপি এ আসনে মনোনয়ন দেয় ভোজপুরি তারকা পবন সিংহকে। সিনেমায় তার ভূমিকা ‘বাঙালিবিরোধী’ বলে দাবি করে সরব হয় তৃণমূল। পবন সরে দাঁড়ান। পরে এখানে প্রার্থী করা হয় অহলুওয়ালিয়ার সিংহকে। তাকে সহজেই হারিয়েছেন ‘খামোস’খ্যাত তারকা।
বর্ধমান-দূর্গাপুর আসনে কীর্তি আজাদকে প্রার্থী করে তৃণমূল। প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজ়াদকে প্রার্থী করার পরে স্থানীয় তৃণমূলের একাংশের আশঙ্কা ছিল, তার ভাষার সমস্যা গ্রামীণ এলাকায় জনসংযোগে অন্তরায় হতে পারে। বিজেপি প্রার্থী ও দলটির সর্বভারতীয় সহসভাপতি দিলীপ ঘোষ কীর্তিকে ‘বহিরাগত’ উল্লেখ করে তাকে ‘প্যাক’ করে বিহারে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা বলেন।
তবে ভোটের ফলে দেখা গেল ১ লাখ ৩৭ হাজার ভোটে জিতেছেন ৮৩’র বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার কীর্তি। রাজনীতিতে নেমে প্রথমবারেই লোকসভার সংসদ সদস্য (এমপি) হয়েছেন দেব। সেই জয়রথ থামল না, টানা তৃতীয়বারের মতো এমপি হলেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদেনীপুরের ঘাটাল কেন্দ্র থেকে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী দেব হারিয়েছেন টলিউডের আরেক তারকা হিরণ চট্টোপাধ্যায়কে। ১ লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন দেব।
২০১৪ এবং ২০১৯, পর পর দুবার ঘাটাল থেকে জিতেছেন দেব। গতবার বিজেপি প্রার্থী ভারতী ঘোষকে হারান তিনি। এবার অভিনেতা, বিধায়ক হিরণ চট্টোপাধ্যায়কে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। তবে দেবের কাছে হেরে গেলেন হিরণ।
রাজনীতির মাঠে নেমেই চমক দেখালেন টলিউড অভিনেত্রী রচনা বন্দোপাধ্যায়। লোকসভা নির্বাচনে হুগলি আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী রচনা হারালেন বিজেপির প্রার্থী, টলিউডের আরেক অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়কে। প্রায় ৩০ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন রচনা।
কিন্তু ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা গেছে, একের পর এক প্রার্থীর হেরে যাওয়ার কারণে লক্ষ্যের ধারে কাছেও যেতে পারেনি দলটি। এবারের নির্বাচনেও সম্ভবত তেমনই ঘটতে যাচ্ছে, অর্থাৎ অতীতের পুনরাবৃত্তি। নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক ফলাফলে জানা গেছে, রাজ্যের ৪২টি সংসদীয় আসনের ৩১টিতেই জিততে যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস, ১০টিতে বিজেপি এবং একটিতে কংগ্রেস।
এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে দেশটির লোকসভার ৫৪৩টি আসনের নির্বাচন সাত ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে কোনো দল বা জোটকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে কমপক্ষে ২৭২টি আসনে জিততে হবে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় নির্বাচন বলে পরিচিত এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ১০০ কোটি মানুষ ভোটার ছিলেন, যার মধ্যে ৬৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ ভোট দিয়েছেন বলে দেশটির নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনে লড়াই হয়েছে মূলত বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে। ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ প্রকাশিত ফলে দেখা যায়, ৫৪৩টি আসনের মধ্যে এনডিএ পেয়েছে ২৯৩টি এবং ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ২৩১ আসন।