ঢাকা : ধারণার চেয়েও বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির নেতা নরেন্দ্র মোদী। আগের দুবার তিনি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার চালিয়েছিলেন, তবে এবার এককভাবে সরকার গঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা তার দল পায়নি।
লোকসভার ৫৪৫ আসনের মধ্যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য প্রয়োজন ২৭২টি আসন। কিন্তু বিজেপি পেয়েছে ২৪০টি আসন। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট অবশ্য সম্মিলিতভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন পেয়েছে। এনডিএ জোটের মোট আসন সংখ্যা ২৯৩টি। অন্যদিকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছে ২৩৫টি আসন।
জিতলেও এই ফলাফল মোদীর জন্য একটি বড় আঘাত। এর আগে তিনি গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যত নির্বাচন করেছেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। সেই সঙ্গে গত এক দশক ধরে দেশটির জাতীয় রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিলেন।
ভারতের জনগণের এই রায়ের মধ্য দিয়ে দেশটির প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টি ও এর নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের চমকপ্রদ পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। এই নির্বাচনে কংগ্রেসের চূড়ান্ত পতন নিয়ে সব ভবিষ্যদ্বাণী এবং বুথফেরত ও নির্বাচনপূর্ব জরিপগুলোর ফলাফল ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
বিশ্বের অনেক নেতাকেই তাদের তৃতীয় দফার নির্বাচনে কষ্ট করে হামাগুড়ি দিয়ে শেষ লাইন পেরোতে হয়েছে। মোদীও এখন তাদেরই একজন। অবশ্য, আসনের দিক থেকে বিজেপি এখনও ভারতের একক বৃহত্তম দল হিসেবেই রয়ে গেছে।
মিত্রদের সমর্থনে তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া প্রায় নিশ্চিত করেছেন মোদী, তাহলে তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের একজন এবং দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর রেকর্ডে ভাগ বসাবেন।
ভারতে এর আগে একমাত্র নেহরুই টানা তিনবার পাঁচ বছর মেয়াদের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন এবং টানা ১৭ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। আর মেয়াদ সম্পন্ন করলে মোদী ক্ষমতায় থাকছেন টানা ১৫ বছর।
কিন্তু তার দল গতবারের চেয়ে এবার ৬৩টি কম আসন পাওয়ায় তার তৃতীয় মেয়াদের উজ্জ্বলতা অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। মোদী এবার তার দল বিজেপির জন্য এককভাবে ৩৭০ আসনে আর জোটগতভাবে ৪০০ আসনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন। সে হিসাবে দলগতভাবে ২৪০ আর জোটগতভাবে ২৯৩ আসন অনেক কম অর্জন।
এই ফলাফল কংগ্রেস শিবিরে উল্লাস এবং বিজেপি মহলে কিছুটা হতাশা তৈরি করেছে। বিজেপি একক বৃহত্তম দল হিসেবে থাকা সত্ত্বেও প্রচার এবং প্রত্যাশার বোঝা তাদের অনেক সমর্থককে হতাশ করেছে।
মোদীর সমর্থকদের বিশ্বাস, তার নেতৃত্বাধীন জোটের তৃতীয় মেয়াদে জয়লাভের পেছনে কয়েকটি বিষয় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। যেমন, মোদী সরকারের স্থিতিশীল শাসনের রেকর্ড, ধারাবাহিকতার আবেদন, কার্যকর জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং এই উপলব্ধি যে, তিনি ভারতের বৈশ্বিক ভাবমূর্তি উন্নত করেছেন।
এছাড়া মোদী তার হিন্দু জাতীয়তাবাদী সমর্থকদের দেওয়া প্রধান প্রতিশ্রুতিগুলোও পূরণ করেছেন। যেমন, ভারত-শাসিত কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন প্রত্যাহার ও অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ এবং বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়ন করেছেন। বিজেপিশাসিত অনেক রাজ্যেই হিন্দু-মুসলিম বিয়ে তথা আন্তঃধর্মীয় বিয়ে বন্ধেও কঠোর আইন করা হয়েছে।
তারপরও বিজেপির আসন কমার উল্লেখযোগ্য কারণ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে বেকারত্ব বাড়া, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য এবং সেনাবাহিনীতে নিয়োগ ব্যবস্থার বিতর্কিত সংস্কার। মোদীর বিভাজনমূলক সাম্প্রদায়িক প্রচার, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কথা-বার্তাও কিছু কিছু অঞ্চলে তার ভোট কমার একটি কারণ ছিল।
মোদীর উচ্চাভিলাষী স্লোগান ‘আবকি বার, ৪০০ পার’ তথা তার এনডিএ জোটের জন্য ৪০০টিরও বেশি আসনের লক্ষ্য নির্ধারণও হয়ত দরিদ্র ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংবিধানিক পরিবর্তনের ভয় জাগিয়েছে।
চারশর বেশি আসন পেলে মোদী নিজের ইচ্ছামতো ভারতের সংবিধানকেই বদলে ফেলতে পারতেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, এমন সুযোগ পেলে মোদী শুধু ধনিক শ্রেণি এবং উচ্চ বর্ণের মানুষদেরই সুবিধা করে দেবেন। বঞ্চিত হবে কৃষক-শ্রমিকসহ নিম্ন বর্ণ, সংখ্যালঘু ও অবেহেলিত জাত-পাতের মানুষরা।
‘চারশে পার’ স্লোগান দেওয়ার পর থেকেই বিরোধী নেতারাও ক্রমাগত প্রশ্ন তুলে আসছিলেন, এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী আসলে কী করতে চান? তার উদ্দেশ্যটা কী?
তার মধ্যেই কর্নাটকে বিজেপির তখনকার এক এমপি বলে বসেন, ‘চারশো পার’ আসন পেলে তাহলেই দল প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধন করতে পারবে এবং হিন্দুরাষ্ট্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সফলভাবে এগোতে পারবে। যদিও পরে বিজেপি সেই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করে।
ভারতে সংবিধান সংশোধন করতে হলে পার্লামেন্টের উভয় কক্ষেই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা জরুরি। লোকসভার ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা ৩৬১ বা তার কাছাকাছি।
মোদীর দল সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে উত্তর প্রদেশে (ইউপি)। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল এই রাজ্যে সংসদীয় আসনও সবচেয়ে বেশি। ৮০টি আসনের উত্তর প্রদেশ দেশটির কেন্দ্রে কে সরকার গঠন করবে, তা ঠিক করে দেয় বরাবরেই। দিল্লির প্রবেশদ্বারও বলা হয় উত্তর প্রদেশকে।
উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টির নিম্নবর্গের, পিছিয়ে পড়া, অবহেলিত ও মুসলমানদের মতো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের প্রার্থী করার কৌশলের কাছে পরাস্ত হয় বিজেপি।
প্রকাশক : মোহাম্মদ বদরুজ্জামান তালুকদার
সম্পাদক : খান মোহাম্মদ সালেক
Copyright © 2025 Daily Dhaka Press. All rights reserved.