হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যু ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির জন্য একটি বড় ধাক্কা। হানিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর গাজায় বর্তমানে ভয় এবং উদ্বেগ বিরাজ করছে। এই হত্যার ঘটনাটি অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত এবং তাৎপর্যপূর্ণ।
ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের অভিষেক উপলক্ষে তেহরান সফরকালে গুপ্ত হামলায় নিহত হয়েছেন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া।
ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) বিবৃতিতে জানিয়েছে, মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) ইরানের প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হানিয়া তেহরানে গিয়েছিলেন। তিনি যে ভবনে অবস্থান করছিলেন সেখানে হামলা চালানো হলে হানিয়া এবং তার এক দেহরক্ষী নিহত হয়।
এদিকে হামাসের এক শীর্ষ কর্মকর্তা অঙ্গীকার করেছেন যে, হানিয়া হত্যার জবাব দেওয়া হবে। মুসা আবু মারজুক নামের ওই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে হামাস-নিয়ন্ত্রিত আল আকসা টেলিভিশন চ্যানেলে ওই হামলা ‘কাপুরুষোচিত’ হামলা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে ইসরায়েল এর আগে হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
ইসমাইল হানিয়া হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধানের পদে থাকলেও তাকেই এই গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতা মনে করা হয়। গত শতকের আশির দশকে হামাসের উত্থানকালে ফিলিস্তিনি সুন্নি মুসলিমদের এই রাজনৈতিক ও সামরিক আন্দোলনের সামনের কাতারে ছিলেন তিনি।
১৯৬৩ সালের ২৯ জানুয়ারি মিশর অধিকৃত গাজা উপত্যকার আল-শাতি উদ্বাস্তু শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন ইসমাইল হানিয়া। ১৯৪৮ আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় তার বাবা মা বর্তমান ইসরায়েলের অন্তর্গত আসকালানের নিকটস্থ বাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু হন। তিনি জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। এরপর গাজা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবি সাহিত্যে স্নাতক হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তিনি হামাসে যোগ দেন।
১৯৮৫ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতিনিধি ছাত্র কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন। ইসলামিক অ্যাসোসিয়েশন ফুটবল দলে তিনি মিডফিল্ডার হিসেবে খেলতেন। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম ইন্তিফাদার প্রায় সমসাময়িক কালে তিনি স্নাতক হন। বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার কারণে তিনি ইসরায়েলে স্বল্পকালীন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৮৮ সালে তিনি পুনরায় ইসরায়েল কর্তৃক গ্রেফতার হন এবং ছয় মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৮৯ সালে তিনি তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
১৯৯২ সালে মুক্তি পাওয়ার পর আবদুল আজিজ আল-রানতিসি, মাহমুদ জাহহার ও আরও ৪০০ কর্মীর সঙ্গে ইসরায়েল তাকে লেবানন পাঠিয়ে দেয়। তারা দক্ষিণ লেবাননের মার্জ আল-জহুরে এক বছর অবস্থান করেছিলেন। বিবিসির মতে এখানে হামাস যথেষ্ট পরিমাণে মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠে। এক বছর পর তিনি গাজায় ফিরে আসেন এবং ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন নিযুক্ত হন।
১৯৯৭ সালে আহমেদ ইয়াসিন ইসরায়েল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর হানিয়া তার দফতর পরিচালনের দায়িত্ব পান। ইয়াসিনের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে হামাসে তার খ্যাতি বৃদ্ধি পায় এবং তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষে নিয়োগ পান। ইয়াসিনের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে হামাসের অনেক নেতার হত্যাকাণ্ডের ফলে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় হামাসে তার অবস্থান আরও মজবুত হয়। ইসরায়েলি বাহিনী তাকেও লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিল।
২০০৩ সালে জেরুজালেমে আত্মঘাতী বোমা হামলার পর হামাস নেতৃত্বকে উৎখাতের উদ্দেশ্যে পরিচালিত ইসরায়েলি বোমা হামলায় তিনি আহত হয়েছিলে।
২০০৬ সালের ২৫ জানুয়ারি হামাস নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ফেব্রুয়ারিতে তিনি প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন। ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ২৯ মার্চ শপথ নেন।
ফাতাহ-হামাস দ্বন্দ্বের উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১৪ জুন রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আব্বাস তাকে পদচ্যুত করেন। কিন্তু ইসমাইল হানিয়া আদেশ মেনে নেননি এবং গাজায় প্রধানমন্ত্রিত্ব করতে থাকেন।