চীনের ইয়ারলুং জাংপো নদীর একটি অংশকে বলা হয় ‘নদীর এভারেস্ট’। কারণ এটি পড়েছে তিব্বত পর্বতমালার ভেতর। ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১ হাজার মিটার গভীর এই অংশে জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে চীন।
গত ২৫ ডিসেম্বর চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া এক প্রতিবেদনে বলেছে, তিব্বতে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে চীন। তিব্বত মালভূমির পূর্ব পাশে এই প্রকল্প শিগগিরই শুরু হতে যাচ্ছে।
চীন সরকারের তথ্যমতে, এই বাঁধ নির্মিত হলে বছরে ৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট–ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। আর এ থেকে ৩০ কোটিরও বেশি মানুষের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।
বর্তমানে চীনে বিশ্বের বৃহত্তম ‘থ্রি জর্জেস বাঁধ’ রয়েছে। কিন্তু ইয়ারলুং জাংপোতে যে বাঁধ নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে, সেটির বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা হবে থ্রি জর্জেস বাঁধের চেয়ে তিনগুণ বেশি।
শি জিনপিং সরকার আশা করছে, নতুন এই বাঁধ নির্মিত হলে ২০৬০ সালের মধ্যে চীন ‘কার্বন নিরপেক্ষ’ দেশে পরিণত হতে পারবে। তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাঁধটি নির্মাণে প্রচুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে চীনকে।
চীনা গণমাধ্যমগুলো বলছে, ইয়ারলুং সাংপোর জলপ্রবাহকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে নামচা বারওয়া পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চার থেকে ছয়টি সুড়ঙ্গ খোঁড়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সুড়ঙ্গগুলো হবে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন মোটেও সহজ হবে না। কারণ যেখানে বাঁধটি নির্মাণের কথা ভাবা হচ্ছে, তার পাশেই একটি টেকটোনিক-প্লেট রয়েছে। ফলে ব্যাপক ভূমিকম্প ঝুঁকিতে পড়বে বাঁধটি।
এসব ঝুঁকি বিবেচনায় রেখেই বাঁধটি নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন চীনা প্রকৌশলীরা। এ জন্য নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ১ ট্রিলিয়ন ইউয়ান বা ১৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বলা হচ্ছে, এটিই হবে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল অবকাঠামো।
১৯৯৪ সালে ইয়াংজি নদীর ওপর ‘থ্রি জর্জেস বাঁধ’ নির্মাণ শুরু করেছিল চীন সরকার। প্রকল্পটি শেষ হয় ২০০৬ সালে। ওই সময়ে বাঁধটি নির্মাণের জন্য ১৩ লাখেরও বেশি মানুষকে ওই এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে হয়েছিল চীন সরকারকে।
তিব্বতে ইয়ারলুং সাংপোর ওপরে নতুন যে বাঁধ নির্মাণের কথা ভাবা হচ্ছে, সেটি যেহেতু থ্রি জর্জেস বাঁধের চেয়েও বড়, তাই ধারণা করা হচ্ছে, সায়ত্ত্বশাসিত তিব্বত থেকেও বহু মানুষকে সরিয়ে নিতে হবে। সংখ্যাটি ১৩ লাখের বেশি হবে কি না, তা অবশ্য এখনই বলা যাচ্ছে না।
তিব্বত অঞ্চলে এবারই প্রথম বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে, তা নয়। এর আগেও সেখানে কয়েক ডজন বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। তবে বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে প্রতিবারই স্থানীয়দের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে। স্থানীয়দের অভিযোগ, চীন সরকার বহু বছর ধরেই এই অঞ্চলকে শোষণ করছে।
গত বছরেও বাঁধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী শত শত মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে শি জিনপিংয়ের সরকার। আশঙ্কা করা হচ্ছে, নতুন প্রকল্প ‘মেদোগ’ ঘিরেও বহু মানুষ বিক্ষোভে শামিল হবে।
এদিকে ভারত ও বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নিম্নপ্রবাহে থাকা ভারত ও বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইয়ারলুং সাংপো নদীর ভারতীয় অংশটি ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত। ভারত ও বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এই নদী নিয়ে তিন দেশের মধ্যে কোনো ‘পানিবন্টন চুক্তি’ নেই।
তাই চীন এখানে বাঁধ নির্মাণ করলে বিশ্বের অন্যতম পানি সঙ্কটাপন্ন দেশ ভারত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একইভাবে ভাটিতে থাকা দেশ বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
তবে চীনের কর্মকর্তারা এসব উদ্বেগ উপেক্ষা করে বলেছেন, তিব্বতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো পরিবেশের ওপর বা নিম্নপ্রবাহে পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো প্রভাব ফেলবে না।
চীনা গবেষকদের মতে, ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর বাঁধ নির্মিত হলে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ বাড়িয়ে উপকূলীয় রাজ্যগুলোকে বরং উপকৃত করা যাবে। কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, মেকং নদীর ওপর চীনের বাঁধ মানুষ ও পরিবেশের কোনো উপকার করেনি। বরং ভাটির দিকের জেলে ও কৃষকেরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
একইভাবে তিব্বতে ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করলেও মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতিই হবে।
নতুন বাঁধটি সম্পন্ন করতে কমপক্ষে দশ বছর সময় লাগবে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশ নিশ্চয়ই চীনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসবে।
সেই আলোচনা কতটুকু ফলপ্রসু হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে চীন। এমনকি বিদ্যুৎ উপৎপাদনের জন্য মহাকাশেও বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে চীন।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট বলছে, ভূপৃষ্ঠ থেকে ৩৬ হাজার কিলোমিটার ওপরে পৃথিবীর জিয়োস্টেশনারি কক্ষপথে এক কিলোমিটার প্রশস্ত সৌর প্যানেল বসানোর পরিকল্পনা করেছে চীনের রকেট বিজ্ঞানী লং লেহাওয়ের নেতৃত্বাধীন একটি গবেষক দল।
সুতরাং বিদ্যুৎ নিয়ে কতটা ক্ষ্যাপাটে অবস্থায় রয়েছে চীন সরকার, তা এই উদ্যোগ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। এ থেকে মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলাই যায় যে, তিব্বতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে মোটেও সরবে না চীন। তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, সিনহুয়া, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট ও রয়টার্স
প্রকাশক : মোহাম্মদ বদরুজ্জামান তালুকদার
সম্পাদক : খান মোহাম্মদ সালেক
Copyright © 2025 Daily Dhaka Press. All rights reserved.