Site icon Daily Dhaka Press

দুরন্ত কন্যা ফিরোজার গল্প

মো: ইকরাম হাসান : সে ছিল রোগা-সোগা দুরন্ত এক মেয়ে। বলছি ১৬ বছরের টগবগে এক যুবতী কন্যা ফিরোজা খাতুনের কথা। কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলায় স্বামী ও একমাত্র ভাইয়ের সাথে তার বসবাস। দুনিয়াতে রক্তের বলতে বছর তিন বড় এই সিরাজ ভাই। বাপ মা হারা একমাত্র বোনের বাড়ি সিরাজের ঠিকানা। সাল ১৯৭১ ইতিমধ্যেই দেশে তখন যুদ্ধ লেগে গেছে, চারদিকে একি আতঙ্ক।

নিজেকে নিয়ে ফিরোজার তেমন চিন্তা না থাকলেও ভাই আর স্বামীকে নিয়ে ভাবনার শেষ নেই তার। এর মধ্যে ভাই সিরাজ সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল দেশ স্বাধীন করতে সে মিলিটারি তে যোগ দিবে। কোনো বাধাই যেন তাকে আটকাবার জোর রাখে না। অবশেষে অশ্রুসিক্ত চোখে ভাইকে বিদায় দেয়া হয়ে গেল। দেখতে দেখতে ডিসেম্বর মাস চলে আসলো আজ দুই দিন। চারদিকে বিজয়ের ধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে পাকবাহিনী তখন দিশেহারা।

তবে কোনো এক অজানা কারনে ফিরোজার মন বড্ড অশান্ত এরই মধ্যে গোমতীর তীরে লেগে গেছে পাইক্কাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর লড়াই,সেখানে আছে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ। মুক্তিকামীদের আক্রমনে শত্রুপক্ষের জাহাজ ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। প্রানে বেচেঁ নেই সেখানে থাকা পাইক্কাদের কেউ। জাহাজে উঠে যখন বাঙ্গালি যোদ্ধাদের আনন্দ উৎসব তখনি বাধলো এক বিপদ। আকাশ পথে টহল দিতে থাকা মিত্রবাহিনী পাকিস্তানি শত্রু ভেবে হামলা চালিয়ে দেয়।কিছু বুঝে উঠার আগেই দুই বীর মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরে। একটি বুলেট কান ছেদ করে গেছে সিরাজের।

এদিকে ফিরোজার মন বড্ড উতলা। কিছু সময় পেরোতেই ভাইয়ের শহীদ হওয়ার ঘটনা তার কানে আসতে বিলম্ব হলো না।কি এক অদ্ভুত শক্তি মেয়েটিকে যেন চিরতরে শান্ত করে দিল।দেশ তখন স্বাধীন কিন্তু মুক্তির আনন্দ ছুতে পারেনি ফিরোজা খাতুনকে। বউ কে হাসি-খুশি রাখতে স্বামী সোনা মিয়ার সব চেষ্টাই যেন বৃথা।এর মধ্যেই সাদামাটা ভাবে কাটছে তাদের জীবন। সাল ২০১৯ আরেকটি ধাক্কা ফিরোজার জীবনে, প্রকৃতির নিয়মে বিধবা হতে হলো।বার্ধক্য জনিত কারণে স্বামীর মৃত্যু। তবু এই শোক যেন ভাই হারানোর সেই বেদনার কাছে কিছুই না। ধীরে ধীরে স্বামী হারানোর শোক বয়সের ভার যেন আরো শান্ত করে দিচ্ছে ফিরোজা খাতুনকে। মেয়ে, মেয়ের জামাই আর একমাত্র নাতির সাথে জীবন কেটে যাচ্ছে তার।

জীবনের এই সময় এসে ফিরোজা খাতুনের সব থেকে আপন মানুষ তার একমাত্র নাতি। সারাক্ষণ ওর সাথে খুনসুটি তে মেতে থাকে। এর মধ্যে সাল ২০২৪ দেশে আবার কি যেন এক দাঙ্গা লেগে গেল, পাড়ার অন্য ছেলেদের সাথে আন্দোলনে যাবে তার কলেজ পড়ুয়া একমাত্র নাতি।আজ আবার কি যেন এক আতঙ্ক ঘিরে ধরেছে ফিরোজা খাতুনকে। নাতি আন্দোলনে যাবে বলে বেড়িয়ে গেল। যতদূর দেখা যাচ্ছে নাতিকে কেবল দেখে যাচ্ছে কি এক মায়ায় চোখ ফেরাতে পারছে না ফিরোজা খাতুন। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গেল উঠোনে বসে আছে নাতি কখন ফিরবে! বিদগুটে রাতে নাতির খুঁজের আলাপ আশেপাশের বাড়িতেও সারা পড়ে গেছে। পুলিশ নাকি আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালিয়ে দিয়েছে, তার নাতির সাথে থাকা আরো অনেকের খুজঁ মিলছে না।

আজ নাতিকে খুঁজতে খুঁজতে বার বার ভাইয়ের কথা মনে পড়ে যায় ফিরোজার। আজ আটদিন কেটে যাচ্ছে নাতির খবর আসছে না। অনেকেই কানাফুসি করছে হয়তো বেচেঁ নেই ফিরোজা খাতুনের বেচেঁ থাকার শেষ সম্বল। মানতে নারাজ বৃদ্ধা বুড়ি, ভাবছে এই বুঝি নাতি বুবু বলে ডাকলো! গ্রীষ্মের প্রচন্ড গরমে শীতল সন্ধ্যার নেয় নাতি পিছন থেকে এসে জড়িয়ে ধরে বলবে ঘরে চলো বুবু। এই বীভৎস সময় গুলো কেটে যাবে নাতি ফিরবে উঠোনে বসে বারংবার এই ভেবে নাতির অপেক্ষা করে ফিরোজা খাতুন। দিন কাটে তার এই ভেবে তবে আসবে কি ফিরোজা খাতুনের ধন, নাকি ফিরবে চূড়ান্ত দুঃসংবাদ হয়ে..!

Exit mobile version