সপ্তাহের শেষ শরীরচর্চার ক্লাস শেষে বাসায় ফিরেই চমকে উঠলেন কুয়েত প্রবাসী লামা। দেখলেন, তিনি আর কুয়েতের নাগরিক নন—এক রাতে বদলে গেছে তার পরিচয়। এমন ঘটনা ঘটেছে আরও হাজারো নারীর সঙ্গে। বিয়ের মাধ্যমে পাওয়া নাগরিকত্ব বাতিল করেছে কুয়েত সরকার, ফলে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েছেন প্রায় ২৬ হাজার নারী।
সরকারি হিসাব বলছে, গত আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ৩৭ হাজারেরও বেশি নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে, যার সিংহভাগ নারী। তবে বাস্তব সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা।
কেন এই সিদ্ধান্ত?
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে কুয়েতের নতুন আমির শেখ মিশাল আল-আহমদ আল-সাবাহ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একের পর এক বিতর্কিত সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তিনি ইতোমধ্যে কুয়েতের সংসদ বাতিল করেছেন, সংবিধানের কিছু ধারা স্থগিত করেছেন এবং এবার নাগরিকত্ব ইস্যুতেও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আমিরের লক্ষ্য হলো ‘কুয়েতি পরিচয়ের পুনর্গঠন’, যাতে রক্তসূত্রে কুয়েতিদের নাগরিকত্ব সীমাবদ্ধ রাখা যায় এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে ভোটার সংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হয়।
মায়েদের টার্গেট করা হয়েছে
এ সিদ্ধান্তের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হয়েছেন নারীরা। মূলত ১৯৮৭ সালের পর যেসব নারী বিয়ের মাধ্যমে কুয়েতি নাগরিকত্ব পেয়েছেন, তাদের অধিকাংশের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে।
জানা গেছে, ১৯৯৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে ৩৮ হাজারের বেশি নারী নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন। এদের অনেকেই এখন নিজের পুরনো জাতীয়তা ফিরে পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করছেন।
এক ভুক্তভোগী নারী লামা বলেন, ‘ওরা মায়েদের টার্গেট করেছে—পরিবারব্যবস্থার হৃদয়কে। আমরা এই দেশের সন্তানদের মা ও দাদি।’
আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয়
নাগরিকত্ব বাতিলের পর বহু নারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্থগিত হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে পেনশন, স্থগিত হয়েছে সামাজিক সুবিধা। যদিও সরকার বলছে, এদের ‘কুয়েতি’ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং কিছু সামাজিক সুবিধা দেওয়া হবে, তবে তারা রাজনৈতিক অধিকার হারাবেন, যেমন ভোটাধিকার।
এক কুয়েতি নাগরিক জানান, তার স্ত্রী দীর্ঘদিনের সরকারি কর্মী ছিলেন। অথচ হঠাৎ করেই তিনি নাগরিকত্ব হারিয়েছেন। ফলস্বরূপ, তার পেনশন ছয় মাস ধরে বন্ধ এবং ব্যাংক ঋণও আটকে আছে।
নিরাপত্তার ছুতো না ভোটার কমানোর চেষ্টা?
বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি শুধু প্রতারণা রোধ নয়—বরং একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক পদক্ষেপ হতে পারে। বিশ্লেষক জর্জিও কাফিয়েরো মন্তব্য করেছেন, ‘নাগরিক সংখ্যা কমিয়ে একটি ছোট ও রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণযোগ্য ভোটার গোষ্ঠী তৈরির চেষ্টা হতে পারে এটি।’
মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, নাগরিকত্বের অধিকার একটি মৌলিক মানবাধিকার। এর অপসারণ ব্যক্তি ও পরিবারকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিকভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে।
কুয়েতে এর আগেও ‘বিদুন’ নামে এক বৃহৎ রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব ছিল, যাদের সংখ্যা প্রায় এক লাখ। এবার আরও হাজার হাজার নারী সেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা দিচ্ছেন। কুয়েতে নাগরিকত্বের রাজনীতি এখন আর শুধু কাগজপত্রের খেলা নয়, এটি হয়ে উঠছে নারীদের জীবনের অস্তিত্বের প্রশ্ন।