Site icon Daily Dhaka Press

বাজেটে যেসব পণ্যের দাম বাড়বে ও কমবে

অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সোমবার (২ জুন) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন। বাজেটের সম্ভাব্য আকার হচ্ছে সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।

যেখানে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। আর ঘাটতির পরিমাণ (অনুদানসহ) দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

জাতীয় সংসদ না থাকায় সোমবার (২ জুন) বেলা ৩টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) অর্থ উপদেষ্টা বাজেট বক্তব্য পেশ করেন। যেখানে জানা গেল কোন খাতে সরকারের বাজেট কত। জানা গেল, কোন পণ্যের দাম বাড়ছে আর কোনটির কমছে। তবে এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই একটি ধারণা পাওয়া গেছে।

নতুন অর্থবছরে জিডিপির চার শতাংশ রেখে ঘাটতি বাজেট ঠিক করা হয়েছে। সম্ভাব্য অঙ্ক দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতি অর্থায়নে জোর দেওয়া হয়েছে ব্যাংক খাতকে। এক লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নেবে সরকার। তবে বৈদেশিক ঋণের অঙ্কও বাড়বে।

এদিকে আইএমএফ-এর চাপ থাকার পরও ভর্তুকি অঙ্ক বাড়ানো হচ্ছে। কৃষি খাতে ভর্তুকি কমবে না। সব মিলে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা বেশি ভর্তুকি ও প্রণোদনায় বরাদ্দ থাকবে।

এ ছাড়া বাজেটে দেশীয় টেক্সটাইল মিলে সুতা উৎপাদনে ভ্যাটহার বাড়ানো হচ্ছে। এতে চাপে পড়বে গ্যাস সংকটে ধুঁকতে থাকা টেক্সটাইল মিলগুলো। প্রতি কেজি কটন সুতা ও ম্যান মেইড ফাইবার সুতার সুনির্দিষ্ট কর (ভ্যাট) তিন থেকে বাড়িয়ে পাঁচ টাকা করা হচ্ছে।

বাড়বে করপোরেট কর : বাজেটে করপোরেট কর বাড়তে পারে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয়, এমন কোম্পানির ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ বাড়িয়ে করপোরেট কর সাড়ে ২৭ শতাংশ করা হতে পারে। ব্যাংকসহ আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থায় লেনদেনের শর্তে করপোরেট কর ২৫ শতাংশই থাকবে। তবে সে শর্ত পূরণ কঠিন হতে পারে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির জন্য ২০ শতাংশ করপোরেট কর অব্যাহত থাকছে। পুঁজিবাজারে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা মার্চেন্ট ব্যাংকের করহার সাড়ে ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ২৭ শতাংশ করার প্রস্তাবও করতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা। এ ছাড়া সিকিউরিটিজ লেনদেনের মোট মূল্যের ওপর ব্রোকারেজ হাউজগুলোর ওপর করহার কমানো হতে পারে।

জমি কেনাবেচায় করছাড় : বর্তমানে জমি কেনায় করহার বেশি। এই করহার কমানোর প্রস্তাব করতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা, যাতে কালোটাকা তৈরি না হয়। এখন কর ফাঁকি দিতে অনেকেই জমির মূল্য কম দেখান। এতে কালোটাকা তৈরি হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, জমি কেনাবেচার ওপর কর এলাকাভেদে ছয়, চার ও তিন শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে; যা এখন আট, ছয় ও চার শতাংশ।

ফ্ল্যাট ও জমি কেনায় কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হতে পারে। সেক্ষেত্রে বর্তমানে যে করহার আছে; তা এলাকাভেদে কয়েক গুণ বাড়ানো হবে বলে জানা গেছে। এমনকি অর্থের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করার সুযোগও রাখা হতে পারে।

বাজেট বক্তৃতায় পাচার অর্থ ও সম্পদের ওপর কর ও জরিমানা আরোপ করার ঘোষণা দিতে পারেন অর্থ উপদেষ্টা। জানা গেছে, জন্মসূত্রে বাংলাদেশি ছিলেন, কিন্তু পরে নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন, এমন ব্যক্তিরা যদি বাংলাদেশে অর্জিত আয়ের ওপর যথাযথভাবে কর না দেন এবং নানা উপায়ে বিদেশে পাচার করেন, তাহলে ওই অর্থের ওপর কর ও জরিমানা আরোপ করা হতে পারে।

অন্যদিকে শিল্পের লাভ-লোকসান যাই হোক-বাজেটে দ্বিগুণ হারে টার্নওভার কর দিতে হবে। অবশ্য টার্নওভারের সীমা এক কোটি বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হচ্ছে। এ পদক্ষেপের ফলে শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ব্যবসা পরিচালনার জন্য রাজধানীর প্রায় সব প্রতিষ্ঠানকে স্থাপনা ভাড়া নিতে হয়। এ ভাড়ার উৎসে কর পাঁচ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে।

এ ছাড়া শিল্পের কর অবকাশ সুবিধাও বাতিল করা হচ্ছে। বর্তমানে ৩১টি শিল্প খাত ১০ বছরের জন্য অঞ্চলভেদে ক্রমহ্রাসমান হারে কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করছে।

ভ্যাট ও আমদানি শুল্ক খাতেও করের বোঝা চাপানো হচ্ছে। অব্যাহতির সংস্কৃতি পরিহার করতে রেফ্রিজারেটর, এয়ারকন্ডিশনার, পলিপ্রোপাইন স্টাপল ফাইবারের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া মোবাইল ফোন উৎপাদনে হ্রাসকৃত ভ্যাট হার বাড়ানো হচ্ছে। এতে ইলেকট্রনিক্স শিল্পের সুরক্ষা কমবে, বিদেশি ইলেকট্রনিক্স-সামগ্রী আমদানি বাড়বে। পাশাপাশি ক্রেতার খরচ বাড়বে।

গ্রামাঞ্চলে ব্যবহৃত সিমেন্ট শিট উৎপাদনে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আছে, এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। স্টিলশিল্পের কাঁচামাল ফেরো ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো সিলিকা ম্যাঙ্গানিজ অ্যালয় উৎপাদনে টনপ্রতি এক হাজার টাকা ভ্যাট আছে, এটি এক হাজার ২০০ টাকা করা হচ্ছে। ফেরো সিলিকন অ্যালয়ের ভ্যাট দেড় হাজার টাকা করা হচ্ছে।

অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করে ভ্যাটহার বাড়ানো হচ্ছে হোম অ্যাপ্লায়েন্স বা গৃহস্থালিসামগ্রী উৎপাদনে। ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, ইলেকট্রিক কেতলি, আয়রন, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার ও প্রেসার কুকার উৎপাদনে ২০২৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত পাঁচ শতাংশ, ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে সাত শতাংশ এবং ২০৩০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে। লিফটের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করে উৎপাদনের জন্য উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে বছরভিত্তিক ভ্যাটহার বাড়ানো হচ্ছে।

এবারের বাজেট সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়াবে। হোম অ্যাপ্লায়েন্স, রেফ্রিজারেটর ও এয়ারকন্ডিশন শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা প্রত্যাহার করায় বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়বে। এর প্রভাব পড়বে জনগণের ওপর। অনলাইনে পণ্য বিক্রির দিকেও বাজেটে নজর দেওয়া হয়েছে।

বাসা-বাড়িতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের তৈরি টেবিলওয়্যার, কিচেনওয়্যার, গৃহস্থালিসামগ্রী, হাইজেনিক ও টয়লেটসামগ্রী উৎপাদনে ভ্যাট সাড়ে সাত থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। বর্তমান অনলাইনে পণ্য বিক্রয়ের ওপর পাঁচ শতাংশ ভ্যাট আছে, বাজেটে এটি ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে বিধায় অনলাইনে পণ্য কেনায় ভোক্তাদের বাড়তি অর্থ গুনতে হবে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরে ব্যাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির করসীমা বাড়ছে না। তবে ২০২৬-২৭ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির সাধারণ করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা করা হচ্ছে।

আগামী বাজেটে সরবরাহ পর্যায়ে আইসক্রিমের সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করা হচ্ছে। এ কারণে বাজারে আইসক্রিমের দাম কমতে পারে। বাস-মাইক্রোবাস-যানজট কমাতে ১৬ থেকে ৪০ আসনবিশিষ্ট বাস আমদানিতে শুল্ক কমতে পারে। বর্তমানে এ ধরনের যানবাহন আমদানিতে ১০ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আছে। এটি কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করা হচ্ছে।

এ ছাড়া মাইক্রোবাসের সম্পূর শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে বাস-মাইক্রোবাসের দাম কমতে পারে। লবণ-আয়োডিনযুক্ত লবণ উৎপাদনের ব্যবহৃত পটাশিয়াম আয়োডেট দাম বাড়ায় বাজারে লবণের দাম বাড়ছে।

তাই আগামী বাজেটে পটাশিয়াম আয়োডেটের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হচ্ছে। এতে বাজারে লবণের দাম কমতে পারে। চিনি-পরিশোধিত চিনি আমদানিতে সুনির্দিষ্ট শুল্ক টনপ্রতি সাড়ে চার হাজার টাকা থেকে কমিয়ে চার হাজার টাকা করা হচ্ছে। এতে চিনির দাম কমতে পারে।

এ ছাড়া দাম কমতে পারে-মাখন, পোড়ামাটির প্লেট ও পচনশীল উপাদানে তৈরি গ্লাস, প্লেট ও বাটি ইত্যাদি, জাপানের জনপ্রিয় সিফুড স্ক্যালোপ, হোস পাইপ ইত্যাদির। পাশাপাশি জাপানি সিফুড স্ক্যালোপ আমদানিতে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে পাঁচ শতাংশ করা হতে পারে। এতে স্ক্যালোপের দাম কমতে পারে। এ ছাড়া দাম কমতে পারে বিদেশি মাখন, ড্রিংক ইত্যাদির। অন্যদিকে দাম কমতে পারে দেশি শিরিস কাগজের।

Exit mobile version