ভারতের কেরালা-তামিলনাড়ুর সীমান্তের ইদুক্কির পাহাড়ঘেরা এলাকা, কাদুক্কাসিটি। ৮ জুন, রোববার সকালটা ছিল একদম নিরিবিলি। চিরাচরিতভাবেই কার্ডামম বাগানে দিন শুরু করেছিলেন স্থানীয় কৃষকেরা। হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেন ভেসে এলো অদ্ভুত এক গর্জন আর কুকুরের চিৎকার। সবাই ছুট লাগাল সেই শব্দের উৎস খুঁজতে।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে তো তাদের চক্ষু চড়কগাছ! একটা গভীর গর্তে আটকে আছে এক বিশাল বাঘ—আর তার পাশেই একটা কুকুর! এমন দৃশ্য সিনেমাতেও কল্পনা করা যায় না। মনে হতেই পারে—এখনই হয়তো বাঘটা থাবা মারবে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার, দীর্ঘ সময় একসঙ্গে থাকার পরও বাঘটি একবারের জন্যও কুকুরটিকে আক্রমণ করেনি।
স্থানীয়দের ধারণা, বাঘটি পাহাড়ি বনের দিক থেকে লোকালয়ে চলে এসেছিল। সম্ভবত কুকুরটিকে ধাওয়া করছিল শিকার হিসেবে। দৌড়াতে দৌড়াতে দুটোই পড়ে যায় এক গভীর গর্তটিতে, যা বাগানের আবর্জনা ফেলার জন্য খোঁড়া হয়েছিল। প্রায় ১৫ ফুট গভীর সেই গর্ত থেকে কারোই বের হওয়া সম্ভব ছিল না।
বনের কর্মকর্তারা জানালেন, বাঘটি আনুমানিক দু’বছরের। হয়তো পেরিয়ার রিজার্ভ বা তামিলনাড়ু দিক থেকে ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছিল চাষাবাদের এলাকায়।
খবর পেয়ে ছুটে আসে বন দফতরের টিম। প্রথমে তারা গর্তের মুখ ঢেকে দেয় লোহার গ্রিল দিয়ে—যাতে বাঘ অতর্কিতে উঠে আসতে না পারে। তারপর আসে পশু চিকিৎসকদের দল, নেতৃত্বে ছিলেন পেরিয়ার টাইগার রিজার্ভের সহকারী ভেটেরিনারিয়ান ড. অনুরাজ।
প্রথমে বাঘকে ঘুমপাড়ানি ডার্ট দেওয়া হয়, কিন্তু পুরোপুরি কাজ না করায় দ্বিতীয়বার প্রয়োগ করা হয়। এরপর কুকুরকেও সাময়িকভাবে চুপ করিয়ে দেওয়া হয় ঘুমপাড়ানি ওষুধ দিয়ে, কারণ সে একটানা ঘেউ ঘেউ করছিল, যা বাঘকে উত্তেজিত করতে পারত।
দুজনকেই সাবধানে তোলা হয় গর্ত থেকে। কুকুরটি প্রায় অক্ষত ছিল। বাঘের মুখে কিছু কাঁটা লেগে ছিল—সম্ভবত কোনো শুয়োর বা সজারুর সঙ্গে লড়াইয়ে। সেগুলো সরিয়ে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে বাঘটিকে র্যাবিস ভ্যাকসিনও দেওয়া হয়, কারণ সে অনেকক্ষণ একটি অজানা কুকুরের পাশে ছিল।
কুকুর বেঁচে গেল কীভাবে? এটাই সবার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। দুই প্রাণী একসঙ্গে, একজন শিকারি, অন্যজন শিকার—তাও কিছুই ঘটল না? বন কর্মকর্তারা বলেন, ‘বাঘ তখন আতঙ্কে ছিল, ক্ষুধার্ত নয়।
অনেক সময়, যখন বন্যপ্রাণী বিপদে পড়ে, তখন তারা আক্রমণাত্মক না হয়ে রক্ষণাত্মক হয়ে পড়ে। এই বাঘটিও হয়তো কুকুরকে শত্রু নয়, একসাথে ফেঁসে যাওয়া সঙ্গী হিসেবেই দেখেছিল।’
উদ্ধার করা বাঘটিকে পাঠানো হয়েছে থেক্কাডির পেরিয়ার টাইগার রিজার্ভে। কুকুরটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে স্থানীয় এলাকায়। এলাকাবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে, তবে একইসঙ্গে উদ্বেগও বেড়েছে—বাঘ লোকালয়ে চলে আসছে কেন?
তবে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ২০২৩ সালের এক সকালে উত্তরাখন্ডের ইউএস নগরের এক গভীর গর্তে পড়ে যায় একটি চিতা বাঘ আর এক নেড়ি কুকুর। প্রথমে ধারণা করা হয়, চিতা বাঘ হয়তো কুকুরকে ধরতেই গিয়েছিল। কিন্তু দু’জনেই সেখানে পড়ে যাওয়ার পর, চিতা বাঘটি আর কুকুরের দিকে একবারও আক্রমণ করেনি। পরে দুটিকেই জীবিত উদ্ধার করে বনকর্মীরা।
মহারাষ্ট্রের নাসিকের এক গ্রামে ওই বছরই মানে ২০২৩ সালে কুয়োয় আটকা পড়ে একটি চিতা ও একটি গৃহপালিত বিড়াল। গভীর রাতে ভয়ের সেই গর্তে চিতা বাঘটি বিড়ালটিকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেনি। বরং সময়মতো গিয়ে বনদপ্তর উদ্ধার করে জীবন্ত দুই প্রাণীকেই।
এদিকে ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মেমফিসের চিড়িয়াখানায় এক কুকুর আচমকাই ঢুকে পড়েছিল বাঘের খাঁচায়! কিছুক্ষণের জন্য উত্তেজনা ছড়ালেও, বাঘটি তাকে আক্রমণ না করে বরং অবাকভাবে তাকিয়ে ছিল। কুকুরটি হালকা আঘাত পেয়েছিল ঠিকই, তবে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। সূত্র: দ্য হিন্দু, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ম্যানোরামা অনলাইন, ডেকান হ্যারাল্ড
প্রকাশক : মোহাম্মদ বদরুজ্জামান তালুকদার
সম্পাদক : খান মোহাম্মদ সালেক
Copyright © 2025 Daily Dhaka Press. All rights reserved.