
ইরান ও ইসরায়েলের চলমান সংঘাতের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি বাড়ানো শুরু করেছে। আর এটি এমন মাত্রায় গিয়ে ঠেকেছে- যে স্পষ্টতই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনো পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দ্য ওয়্যার জোনে বুধবার (১৮ জুন) প্রকাশিত প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, তারা মধ্যপ্রাচ্যে অতিরিক্ত যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে এবং এরই মধ্যে মোতায়েন থাকা কিছু বিমানের সময়সীমাও বাড়ানো হচ্ছে।
এসব বিমানের মধ্যে রয়েছে চতুর্থ প্রজন্মের এফ-সিক্সটিন, পঞ্চম প্রজন্মের এফ-২২ ও এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান। আপাতত এই যুদ্ধবিমানগুলো ইরান থেকে উড়ে আসা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রগুলো গুলি করে ভূপাতিত করার কাজে ব্যবহার হচ্ছে।
নতুন করে ইউরোপে থাকা ঘাঁটিগুলো থেকে অন্তত ১৭টি কেসি-১৩৫ ও কেসি-৪৬ ট্যাঙ্কার বিমান মধ্যপ্রাচ্যের দিকে রওনা দিয়েছে। এসব ট্যাংকার মূলত যুদ্ধবিমানগুলোকে আকাশপথে জ্বালানি দিয়ে সহায়তা করার জন্য নিয়ে আসা হচ্ছে।
এ ছাড়া প্রকাশ্য ফ্লাইট ট্র্যাকিং তথ্যে দেখা গেছে, গত কয়েক দিনের মধ্যেই ৩১টির বেশি ট্যাঙ্কার আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছে। আরও কিছু ট্যাঙ্কার বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে রওনা দিচ্ছে, যেগুলোর ‘গোল্ড’ কলসাইন থেকে বোঝা যাচ্ছে- এসব বিমানগুলো সাধারণত আন্তঃমহাদেশীয় অভিযানে অংশ নিয়ে থাকে।
বিশ্লেষকদের মতে, এসব ট্যাঙ্কার ও যুদ্ধবিমান মোতায়েন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কৌশলগত প্রস্তুতির অংশ- যাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে প্রয়োজনীয় সামরিক বিকল্প প্রস্তুত থাকে।
যদিও এখন পর্যন্ত সরাসরি কোনো হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, তবে এসব যুদ্ধবিমান ও ট্যাঙ্কার থাকলে প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানো সম্ভব হবে।
দ্য ওয়্যার জোন আরও জানিয়েছে, এফ-২২ বিমানগুলো সম্ভবত ভার্জিনিয়ার ল্যাংলি এয়ার ফোর্স বেস থেকে পাঠানো হচ্ছে। এফ-৩৫ বিমানগুলো ইংল্যান্ডের আরএএফ ল্যাকেনহিথ কিংবা ভারমন্ট এয়ার ন্যাশনাল গার্ডের ঘাঁটি থেকে এসেছে বলে ফ্লাইটপথ থেকে ধারণা করা হচ্ছে।
বুধবারও (১৮ জুন) যুক্তরাজ্যের আকাশে তিনটি এফ-৩৫ স্কোয়াড্রনকে দক্ষিণ দিকে যেতে দেখা গেছে, যেগুলো আরএএফ মিল্ডেনহল ও স্পেনের মোরোন ঘাঁটি থেকে ট্যাঙ্কার বিমানের সহায়তায় উড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলোর গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য।
এ ছাড়া এফ-১৬ বিমানের একটি বহর ইতালির অ্যাভিয়ানো এয়ার বেস থেকে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে বলে জানা গেছে। এসব বিমান আগে থেকেই ইয়েমেনে ইরান সমর্থিত হুথি মিলিশিয়ার ড্রোন ভূপাতিত করতে ব্যবহার করা হচ্ছিল, যেখানে তারা অ্যাডভান্সড প্রেসিশন কিল ওয়েপন সিস্টেম টু (এপিকেডব্লিউএস টু) রকেট ব্যবহার করেছে। এপিডব্লিউএস টু সংযুক্ত এফ-১৫ই স্ট্রাইক ঈগল যুদ্ধবিমানগুলোও গত বছর ইসরায়েলে ইরানের হামলার সময় আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন প্রতিরোধে বড় ভূমিকা রেখেছিল।
এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে দ্বিতীয় একটি এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার স্ট্রাইক গ্রুপ পাঠানো হয়েছে, যার নেতৃত্বে রয়েছে ইউএসএস নিমিৎজ। এটি পূর্ব এশিয়া থেকে যাত্রা করে ইরান ঘেঁষা জলসীমার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
এরই মধ্যে সেখানে রয়েছে ইউএসএস কার্ল ভিনসন। এই যুদ্ধজাহাজগুলো ইসরায়েলের দিকে ছোড়া ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সহায়তা করছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী থেকে পাঠানো প্যাট্রিয়ট এবং থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোও ইসরায়েলের সুরক্ষায় কাজ করছে।
এই বিপুলসংখ্যক ট্যাঙ্কার ও যুদ্ধবিমান মোতায়েন ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র শুধু ড্রোন প্রতিরোধেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছে না, বরং প্রয়োজন হলে ইরানের ভেতরেও টার্গেট আঘাত হানার ক্ষমতা রাখতে চায়।
এমনকি বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, যদি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো বি-টু স্টেলথ বোমার ব্যবহার করে ইসরায়েলকে ইরানের ভূগর্ভস্থ ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানার জন্য সহায়তা করতে পারে।
এই ধরনের স্থাপনায় হামলার জন্য যে বিশাল ক্ষমতার বাঙ্কার বুস্টার বোমা দরকার, তা কেবল বি-টু বোম্বারের পক্ষেই বহন সম্ভব।
পুরো ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ইরান ও ইসরায়েল সংঘাতে সরাসরি জড়িয়ে না পড়লেও যুদ্ধের প্রতিটি সম্ভাব্য ঘুঁটি চালার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে যেতে পারে এবং আগামী দিনগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ আরও সরগরম হতে পারে।