সাম্প্রতিক বছরগুলোতে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান একের পর এক কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত। থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তা ভিডিও ও ছবিতে ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করতেন এক সুন্দরী নারী— যিনি ‘মিস গলফ’ নামে পরিচিত।
পুলিশের বরাতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, অন্তত ৯ জন ভিক্ষুর সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল এবং এর মাধ্যমে তিনি গত তিন বছরে প্রায় ৩৮ কোটি ৫০ লাখ বাথ (প্রায় ১১৮ কোটি টাকা) আদায় করেন।
মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) এক প্রেস ব্রিফিংয়ে থাই পুলিশ জানায়, মিস গলফের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ৮০ হাজারের বেশি ছবি ও ভিডিও পাওয়া গেছে, যেগুলো তিনি ভিক্ষুদের ব্ল্যাকমেইল করতে ব্যবহার করতেন।
পুলিশ বলছে, এসব ভিডিও ধারণের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল করে তিনি নিয়মিত অর্থ আদায় করতেন— এটিই ছিল তার ‘মোডাস অপারেন্ডি’ বা মূল কৌশল।
এই ঘটনা প্রথম সামনে আসে জুনের মাঝামাঝি, যখন ব্যাংককের এক আবধিকা (মঠপ্রধান) আচমকা সন্ন্যাস ত্যাগ করেন। তদন্তে উঠে আসে, ওই ভিক্ষুর সঙ্গে মে ২০২৪-এ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন মিস গলফ।
পরে তিনি দাবি করেন, ভিক্ষুর সন্তান তার গর্ভে এবং এর জন্য সাত মিলিয়ন বাথেরও বেশি ভরণপোষণ দাবি করেন। এরপর পুলিশ জানতে পারে, আরও অনেক ভিক্ষু তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন।
তদন্তকারীরা জানান, অধিকাংশ টাকা ক্যাশে তুলে ফেলা হয়েছে এবং কিছু টাকা ব্যবহার হয়েছে অনলাইন জুয়ায়। ব্ল্যাকমেইল, অর্থপাচার ও চুরি করা সম্পদ গ্রহণের অভিযোগে মিস গলফের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে থাইল্যান্ডের জাতীয় বৌদ্ধ সংস্থা ‘সংঘ সুপ্রিম কাউন্সিল’ একটি বিশেষ কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে, যারা বৌদ্ধ বিধি ও আচরণবিধি পর্যালোচনা করবে।
সরকারও নতুনভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ নিচ্ছে, যাতে ভিক্ষুরা নিয়ম লঙ্ঘন করলে জরিমানা ও কারাদণ্ড দেওয়া যায়।
থাই রাজা মহা ভাজিরালংকর্ন সম্প্রতি ৮১ জন ভিক্ষুকে দেওয়া রাজকীয় উপাধি বাতিল করেছেন। জুনে দেওয়া এসব উপাধি প্রত্যাহারের সময় রাজা বলেন, “ভিক্ষুদের সাম্প্রতিক আচরণে বৌদ্ধ জনতা মানসিকভাবে প্রচণ্ডভাবে কষ্ট পেয়েছে।”
থাইল্যান্ডে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং বহু পুরুষ জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে অস্থায়ীভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন সৎকর্ম বা পূণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে।
ভিক্ষুদের কেলেঙ্কারিতে বিরক্ত থাই রাজা নিজেও। ২০১৭ সালে বিলাসবহুল জীবনযাপন করা ভিক্ষু বিরাপোল সুকফল যৌন অপরাধ, প্রতারণা ও অর্থপাচারের মামলায় আন্তর্জাতিকভাবে শিরোনামে আসেন।
২০২২ সালে দেশটির ফেচাবুন প্রদেশের একটি মন্দিরে অভিযান চালিয়ে মাদকসহ চারজন ভিক্ষুকে গ্রেপ্তার করে, ফলে পুরো মন্দিরই ভিক্ষুশূন্য হয়ে পড়ে।
ধর্মতাত্ত্বিকদের মতে, বহু সমালোচনা ও কেলেঙ্কারির পরও থাই সংঘে বাস্তবিক কোনো সংস্কার হয়নি।
ব্যাংককের থাম্মাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ববিদ প্রাকিরাতি সতাসুত বলেন, “সত্য প্রকাশ করাটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যাতে জনমনে যে সংশয় তৈরি হয়েছে, তা দূর হয়।”
ধর্মবিশারদ সুরাফত থাভিসাকের ভাষায়, “এটি একটি কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা, যেখানে সিনিয়র ভিক্ষুরা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং জুনিয়ররা তাদের অধীনস্ত। তারা অনিয়ম দেখলেও মুখ খোলেন না, কারণ মঠ থেকে বের করে দেওয়া খুবই সহজ।”
তবে আশার কথা, পুলিশ ও সংঘ কাউন্সিলের চলমান তদন্ত হয়তো প্রয়োজনীয় সংস্কারের পথ খুলে দিতে পারে। যেমনটি প্রাকিরাতি সতাসুত বলেন, “এই প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে হলে কাউন্সিলকে হয়তো কিছু হাত-পা কেটে ফেলতে হবে।”
প্রকাশক : মোহাম্মদ বদরুজ্জামান তালুকদার
সম্পাদক : খান মোহাম্মদ সালেক
Copyright © 2025 Daily Dhaka Press. All rights reserved.