Site icon Daily Dhaka Press

রুপালি গিটার ছেড়ে যাওয়ার পাঁচ বছর

ঢাকা : ব্যান্ডজগতের তিনি রাজপুত্র। কিংবদন্তি গায়ক, গীতিকার, সুরকার ও গিটারবাদক আইয়ুব বাচ্চুর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০১৮ সালের এই দিনে রুপালি গিটার ফেলে তিনি চলে গেছেন বহুদূরে। তবু নিজের গানের প্রতিটি লাইনে হয়ে আছেন জীবন্ত।

জীবনে কখনও কখনও থমকে দাঁড়াতে হয়। তবে কিংবদন্তিদের ক্ষেত্রে এমন উক্তি যে খাটে না। জীবনে হয়তো ক্ষণিকের জন্য প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন সর্বদাই নিজ লক্ষ্যে অবিচল। সেজন্য ২৭ বছরের ব্যান্ডসংগীত ক্যারিয়ারে আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা গিটারবাদক।

চট্টগ্রামে জন্ম নেওয়া আইয়ুব বাচ্চু সফল সংগীতজীবনে দেশব্যাপী পরিচিতি পেয়েছিলেন অনেক আগেই। কীর্তিময়, কর্মমুখর জীবন তাকে এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পরিচিতিও।

বরেণ্য এই শিল্পী ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ইসহাক চৌধুরী এবং মায়ের নাম নুরজাহান বেগম। বাচ্চুর শৈশব কাটে চট্টগ্রামেই। রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান হওয়ায় সংগীতকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে বেশ বেগ পোহাতে হয় তাকে।

চট্টগ্রামের সরকারি মুসলিম হাইস্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু হয় তার। কৈশোরেই ব্রিটিশ ও আমেরিকান রকসংগীত শুনতে শুরু করেন বাচ্চু। সেই থেকে এ ধারার সংগীতের প্রতি অনুরক্ত তিনি। তার প্রথম ব্যান্ডের নাম ‘সোলস’। আশির দশকের শুরুর দিকে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ওই ব্যান্ডে যোগ দেন তিনি। ‘হারানো বিকেলের গল্প’ শিরোনামে গানে প্রথম কণ্ঠ দেন বাচ্চু। শহীদ মাহমুদ জঙ্গি লিখেছিলেন গানটি।

১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সোলস থেকেই শ্রোতাদের হৃদয়ে একের পর এক আঁচড় কেটেছেন আইয়ুব বাচ্চু। ১৯৮৬ সালে তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’ মুক্তি পায়। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পায় দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘ময়না’।

১৯৯০ সালে যাত্রা হয় আইয়ুব বাচ্চুর নিজের ব্যান্ডদল। তবে শুরুতে এর নাম ‘এলআরবি’ নয়, ‘ইয়েলো রিভার ব্যান্ড’ (ওয়াইআরবি)’ ছিল। বাংলাদেশের প্রথম ডাবল অ্যালবাম ‘এলআরবি-১’ ও ‘এলআরবি-২’ মুক্তি পায় তারই হাত ধরে।

তার ব্যান্ড অ্যালবামগুলোর মধ্যে রয়েছে— এলআরবি, সুখ, তবুও, ঘুমন্ত শহরে, ফেরারি মন, স্বপ্ন, আমাদের বিস্ময়, মন চাইলে মন পাবে, অচেনা জীবন, মনে আছে নাকি নেই, স্পর্শ ও যুদ্ধ। বেশকিছু জনপ্রিয় একক অ্যালবামও উপহার দেন বাচ্চু। এর মধ্যে রক্তগোলাপ, ময়না, কষ্ট, সময়, একা, প্রেম তুমি কী! দুটি মন, কাফেলা, প্রেম প্রেমের মতো, পথের গান, ভাটির টানে মাটির গানে, জীবন, বলিনি কখনো, জীবনের গল্প উল্লেখযোগ্য।

চলচ্চিত্রেও তুমুল সাফল্য পেয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। তার কণ্ঠে ‘আম্মাজান’ সিনেমায় আম্মাজান গানটি সারা বাংলার মানুষকে মোহিত করেছে। এ ছাড়া আরও বেশকিছু সিনেমার গানে তিনি দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।

এ ছাড়া বিভিন্ন কনসার্টে গান গাইতে দেখা যেত তুমুল জনপ্রিয় এই তারকাকে। বিভিন্ন রিয়েলিটি শোয়ের বিচারক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

ব্যক্তিজীবনে আইয়ুব বাচ্চু এক ছেলে ফাইরুজ ও মেয়ে তাজওয়ারের বাবা। তার স্ত্রীর নাম ফেরদৌস চন্দনা। সংগীত, সংসার ও সন্তান এ নিয়েই আনন্দে জীবনটা কাটিয়ে গেছেন তিনি। মৃত্যুর আগে থেকেই নানানরকম অসুখ চোখ রাঙাচ্ছিল। ২০০৯ সালে হার্টে রিং পরানো হয়েছিল আইয়ুব বাচ্চুর। ফুসফুসে পানি জমায় ২০১২ সালের নভেম্বরে ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। সুস্থ হয়ে সংগীতাঙ্গনে ফিরে এসে আবারও কাজ শুরু করেন।

২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর রংপুর জিলা স্কুলে ‘শেকড়ের সন্ধানে’ শিরোনামে একটি কনসার্টে অংশ নেন বাচ্চু। সেখান থেকে ঢাকায় ফিরেই অসুস্থতা বোধ করেন। ১৮ অক্টোবর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে বাসা থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাংলা সংগীতজগতের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র।

এক সাক্ষাৎকারে আইয়ুব বাচ্চু জানিয়েছিলেন, সব সময় ভালোবাসা জমা করতে চেয়েছেন তিনি। মানুষকে ভালোবেসেছেন মনপ্রাণ উজাড় করে। অনেককে নানাভাবে সহায়তা করেছেন নীরবে নিভৃতে।

জমিয়ে রাখা সব ভালোবাসা তিনি ফেরত পেয়েছিলেন মৃত্যুর পর। ঢাকা ও চট্টগ্রামে সবার প্রিয় ‘এবি বস’-এর একাধিক জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে অংশ নিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। বাচ্চুর বিদায়ের কষ্ট নিয়ে ১৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় এক কনসার্টে শিশুর মতো কেঁদেছিলেন তারই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আরেক রকস্টার জেমস। তার সেই কান্না ছুঁয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। সেদিন প্রমাণ মিলেছিল ভালোবাসা জমা করায় সফল ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু।

Exit mobile version