জাবি প্রতিনিধি: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত ৬টি হল ও একটি গবেষণা কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দুইজন শিক্ষককে সরিয়ে দিয়ে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বসানোর ঘটনা ঘটেছে।
মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) সকাল ১০টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব স্থাপনার উদ্বোধন ঘোষণা করার সময় এ ঘটনা ঘটে।
এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান অডিটোরিয়ামে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যুক্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, হল প্রাধ্যক্ষগণ,শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অনুষ্ঠান শুরুর ২৪ মিনিট পর প্রায় ২০জন নেতাকর্মী সমেত অডিটোরিয়ামে উপস্থিত হন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন। ততক্ষণে অডিটোরিয়াম অতিথিপূর্ণ হয়ে যায়।
পরিপূর্ণ হলরুমে জায়গা না পাওয়ায় ক্ষেপে যান হাবিবুর রহমান লিটন। এসময় তাদের শান্ত করতে প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান উপস্থিত হন। এসময় প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টরের সাথে কথা কাটাকাটি হলে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে প্রক্টর তাদের নিয়ে অডিটোরিয়ামের বাইরে যান। এসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা স্লোগান দিতে শুরু করেন। পরে প্রক্টরের অনুরোধ স্লোগান বন্ধ করেন তারা৷
অডিটোরিয়ামের সামনে প্রক্টরের সাথে আরেক দফায় বাকবিতন্ডায় জড়ান শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন ও তার অনুসারীরা।
এসময় সহ-সভাপতি পদমর্যাদার এক নেতা অনুষ্ঠান চলাকালীন অডিটোরিয়াম ভবনে তালা দেয়ার হুমকি দেন। ঐ নেতা বলেন, ‘আমাদের জন্য জায়গা রাখা হয়নি, আমরা তাহলে অডিটোরিয়ামে তালা দিয়ে চলে যাই।’
এর কিছুক্ষণ পর অডিটোরিয়ামে উপস্থিত হন ছাত্রলীগের শাখা সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তৃতীয় সারিতে বসা প্রাণিবিদ্যা বিভাগ ও দর্শন বিভাগের দুই প্রভাষককে তাদের জায়গা ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করেন প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান৷ পরে শিক্ষকদের যথাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম সারির আসনে বসানো হয়। শিক্ষকদের তৃতীয় সারির আসনে শাখা সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটনকে বসানো হয়।
পরে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পূর্বেই ঐ দুই শিক্ষককে অডিটোরিয়াম হল ত্যাগ করতে দেখা যায়।
প্রধানমন্ত্রীর প্রোগ্রামে ছাত্রলীগের এমন আচরণকে ‘অশোভন’ ও শিক্ষকদের জন্য ‘লজ্জাকর’ বলে মন্তব্য করেন উপস্থিত শিক্ষকরা। জীববিজ্ঞান অনুষদের এক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক বলেন, এমন জাঁকজমক পূর্ণ অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের এমন আচরণ খুবই অশোভন। ভরা মজলিসে দুইজন সম্মানিত শিক্ষককে তুলে দিয়ে সেই জায়গায় ছাত্রলীগ নেতাদের বসানো শিক্ষকদের জন্য অসম্মানজনক ও লজ্জার। আমি এই ঘটনার নিন্দা জানাই।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন একটা অনুষ্ঠানে অধ্যাপকদের চিঠি দিয়ে দাওয়াত করা হয়নি। পূর্বে এরকম কোন ঘটনার নজির নেই। প্রশাসন সম্ভবত: বিরোধীমত পোষণকারীদের ভয় পায়, তাদের উপস্থিতিতে অস্বস্তিবোধ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনুষ্ঠানে উপস্থিত আরেক অধ্যাপক বলেন, ষষ্ঠ ও সপ্তম সারিতে জায়গা যখন ফাঁকাই ছিল তখন ছাত্রলীগ নেতাদের সেই আসনে বসানো যেতো। দুইজন শিক্ষককে তুলে দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। তাদেরকে তুলে দিয়ে শিক্ষক সমাজকে নিচু করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, আমরা ছাত্রলীগকে আগে আসতে বলেছিলাম। আগে আসলে এই ঘটনা ঘটতো না। সকল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দাবি করেছিল যে স্ক্রীনে যাতে সভাপতি-সেক্রেটারিকে দেখা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সারিতে বসতে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমার ওখানে অনুরোধ করার মত জুনিয়র ঐ দুজনই (শিক্ষক) ছিল। আর অন্য কাউকে অনুরোধ করার কোন সুযোগ ছিল না। বেশিরভাগ সিনিয়র এবং অন্য অপরিচিত যারা, স্কুল কলেজের শিক্ষক-অফিসাররা সেখানে ছিল। এই দু’জন আমার অত্যন্ত কাছের এবং আপনজন দেখেই আমি তাদের অনুরোধ করতে পেরেছি। তারা হয়তো মনে কষ্ট পেলেও অনুরোধ রেখেছে।
প্রক্টর আরও বলেন, আমাদের তো সব মিলিয়ে সমন্বয় করতে হয়। ওরা আগে আসলে এই সমস্যাটা হত না। সামনের দিকে বসতে পারত। আমি প্রত্যাশা করব যে, এর পরে কোন প্রোগ্রামে তারা যেন নির্দিষ্ট সময়ে আসে এবং তারা যেখানে বসতে চায়, সেখানে বসতে পারে। পুরো প্রোগ্রামটা শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার স্বার্থেই আমি খুব কাছের দু’জন মানুষকে অনুরোধ করেছি।”
শিক্ষক সমিতির সম্পাদক অধ্যাপক ড. এম শামীম কায়সার বলেন, “শিক্ষার্থীরা অডিটরিয়ামের দ্বিতীয় তলায় বসবেন এটিই পূর্বনির্ধারিত ছিল। শিক্ষার্থীদের তো সেখানে বসার কথা ছিল না। কিন্তু তবুও কোনো শিক্ষকের সাথে যদি এরকম ঘটনা ঘটে থাকে এবং তিনি যদি আমাকে (শিক্ষক সমিতির সম্পাদক হিসেবে) অনানুষ্ঠানিকভাবেও জানান তাহলে আমরা শিক্ষক সমিতি এর প্রতিবাদ করব। আর এ বিষয়টি নিয়ে আমি প্রক্টরের সাথে কথা বলে দেখব কি ঘটেছিল সেখানে।”
এবিষয়ে জানতে চেয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা সাড়া দেননি।