স্টাফ রিপোর্টার:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একটি কলেজে পড়াশোনা করেন রাজধানীর গুলশান এলাকার বাসিন্দা জুই আক্তার। মালদ্বীপ ভ্রমনে যাওয়ার জন্য ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান ‘ট্রিপকার্ডের’ সাথে ফেসুবকের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কম মূল্যে আকর্ষণীয় প্রাইজ দেখে আকৃষ্ট হন জুই।
এরপর ভিসা ও অন্যান্য খরচের জন্য ৫৫ হাজার দেন। কিন্তু টাকা দেওয়ার কিছু দিন পরই দেখতে পান তাদের ‘ট্রিপকার্ড’র অফিস বন্ধ। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তারা অফিস ছেড়ে চলে গেছেন। নানা ভাবে চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ করতে পারেন নি। পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার আশায় টাকা দিয়ে প্রতারণার শিকার হন জুই। একই ভাবে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণার শিকার হয়েছেন শতাধিক মানুষ।
সম্প্রতি রাজধানীর বনানী থানায় এক ভুক্তভোগী বাদী হয়ে ‘ট্রিপকার্ডের’ নামের কথিত এই ট্যুর অপরেটরের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় বাদী উল্লেখ করেন, চলতি বছরের ১৯ আগস্ট থেকে ওই কোম্পানী ফেসবুকের মাধ্যমে কক্সবাজারসহ মালদ্বীপ, শ্রীলংকার, থাইল্যান্ডে ট্যুর প্যাকেজের বিভিন্ন লোভনীয় অফার দিয়ে আসছিল।
পরবর্তীতে কম টাকায় বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার জন্য তিন বন্ধু মিলে ট্যুর প্যাকেজে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং দুবাই যাওয়ার জন্য বুকিং দেন। এজন্য তারা কয়েক দফায় ব্যাংক ও নগদে প্রায় তিন লাখেরও বেশি টাকা দেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘুরতে যাওয়ার জন্য টাকা পয়সা দেওয়ার পরেও বিদেশে আর নিয়ে যায় না।
বরং নানাভাবে কালক্ষেপণ করতে থাকে। এমন কি টাকা চেয়ে যোগাযোগ করলে কথিত এই ‘ট্রিপকার্ড’র মালিক বাদীকে হত্যার হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে অফিসসহ যোগাযোগের সকল নাম্বার বন্ধ করে দেয়।প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে মামলা করেন ওই ভুক্তভোগী।
মামলা তদন্তে নেমে পর্যটকদের বিশ্বাসকে পুঁজি করে প্রতারণায় জড়িত চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহনাগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, চক্রটি অল্প দামে ট্যুর প্যাকেজ বিক্রির নামে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছিল। গত এক বছরে এই চক্রের হাতে দুই শতাধিক ব্যক্তি প্রতারিত হয়েছেন। অপু ও তার চক্রের সদস্যরা গ্রেফতারের খবরে বহু ভুক্তভোগী গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে ভীড় করেছেন।
গ্রেফতারকৃতরা হলো- চক্রের মূলহোতা ও প্রতিষ্ঠানের মালিক সাইফুল আলম ওরফে অপু ও তার আপন ভাই মো. আহাদ আলম ওরফে তালহা ও প্রতিষ্ঠানের কথিত এডমিন মো. আমিনুল ইসলাম।
এ সময় তাদের কাছ একটি ল্যাপটপ, ১৪টি পাসপোর্ট, ১০টি মোবাইল ফোন, ১৫টি সিমকার্ড, ২টি ল্যান্ডফোন, একটি ওয়াকিটকি সেট, একটি সিপিইউ ডেক্সটপ, পাঁচটি এটিএম কার্ড, ছয়টি ব্যাংক চেক উদ্ধার করা হয়।
মঙ্গলবার ( ৫ ডিসেম্বর )দুপুরে রাজধানীর মিন্টু রোডে ডিবিতে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘ট্রিপকার্ড’র নামের কথিত এই ট্যুর অপরেটর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন পেইজ দিয়ে বিজ্ঞাপন দিত। তারা বিভিন্ন প্যাকেজের আওতায় দিন ও রাত থাকা, হোটেলে বুকিং, এয়ারপোর্ট পিকআপ, ড্রপআপ, গাইডের মাধ্যমে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণের ট্যুর প্যাকেজ ঘোষণা করে। অর্ন্তভুক্ত থাকে।
এক সঙ্গে ৪০ জনের ভিসা ও বিমানের টিকেট কাটাসহ সকল দায়িত্য নিজেরাই পালন করার আশ্বাস দেয়। ফলে কম টাকায় সকল সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জনের জন্য রাজধানীর গুলশান, বারিধারা, ধানমন্ডিসহ অভিজাত এলাকায় অফিস নিত। এক এলাকায় অফিস খুলে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে গাঁ ডাকা দিত।
এরপর দুই মাস আত্মগোপনে থেকে ভিন্ন নামে আরেক এলাকায় একই কাজ করত। অপুর নেতৃত্বে চক্রটি গত ছয় মাসে ৫৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ‘ট্রিপকার্ড’র নামের ওয়েবসাইটের ড্যাশবোর্ডের তথ্যে গত ছয় মাসে শতাধিক মানুষের সঙ্গে প্রতারণার তথ্য পেয়েছে।
যেভাবে প্রতারণার শুরু-
অপুর কথিত এই ‘ট্রিপকার্ড’র নামের ওয়েবসাইটে বিভিন্ন ট্যুর প্যাকেজ দিয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। ট্যুরে যাওয়ার জন্য ওয়েবসাইটের নির্ধারিত টাকার পরিমাণের ৪০% এডভান্স দিয়ে বুকিং নিত চক্রটি। বুকিং মানি প্রতারকরা নির্ধারিত ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করত।
পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশের ট্যুর প্রসেসিং এর জন্য অফিসে ডেকে ট্যুর প্যাকেজের সম্পূর্ণ টাকা নিয়ে নিত। এভাবে মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়ে মোবাইল বন্ধ করে অফিস পরিবর্তন করে ফেলত।
পরে দুই মাস নিজেরা আত্মগোপন করে থাকত। এরপর আবার অন্য নামে ফেসবুকে পেইজ খুলে ও ওয়েবসাইট তৈরি করে আবারও প্রতারণা করত। বুকিং মানির সম্পূর্ন টাকাই প্রতারক চক্র আত্মসাৎ করত।
এই সকল প্রতারক চক্রের হাত থেকে সর্তক থাকার আহবান জানিয়ে মহানগর গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, যে কোন ওয়েবসাইট বা ফেইসবুক পেইজে পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে লেনদেনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।
আকর্ষণীয় ও কম মূল্যের বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ না হয়ে, বৈধ লাইসেন্সধারী ট্রাভল এজেন্সির মাধ্যমে সেবা নিতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির মাধ্যমে এ ধরনের প্রতারণার শিকার হলে থানায় মামলা বা অভিযোগ দিতে হবে। এছাড়া নিজের পাসপোর্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি ।