
জাবি প্রতিনিধি : ‘জুবায়ের আহমেদ হত্যাকান্ডের ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছিল শরীফ এনামুল কবির’– বলে দাবি করেছেন জুবায়েরের বড় ভাই আব্দুল্লাহ আল মামুন।
সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত মামুন আরও বলেন, “উপাচার্য এবং শিক্ষক হিসেবে শরীফ এনামুল কবির ‘অনৈতিক’ একটি কাজ করেছিলেন। এটি একই সাথে ‘বেআইনি’ও।
আমরা এও দেখেছি ওই উপাচার্য আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু সরকার ওনাকে তিরস্কারের পরিবর্তে পুরস্কৃত করে পিএসসির সদস্য বানিয়েছিলেন। এই শরীফ এনামুল কবিরের পৃষ্ঠপোষকতায়ই আমার ভাইকে হত্যা করা হয়। তিনি পরবর্তীতে বিচারব্যবস্থাকেও বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করেছিলেন।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৩৭তম ব্যাচের (২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষ) শিক্ষার্থী জুবায়ের আহমেদ ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ‘উপাচার্য মদদপুষ্ট’ বলে পরিচিত ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় আহত হন। পরদিন (৯ জানুয়ারি) ঢাকার ইউনাইটেড হাসাপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
জুবায়ের আহমেদ মারা যাওয়ার এক যুগ পূর্ণ হয়েছে ৯ জানুয়ারি। এক যুগ পূর্ণ হওয়ার পরও বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছে জুবায়েরের পরিবার। এই হত্যাকাণ্ড বিতর্কিত উপাচার্য শরীফ এনামুল কবীরের মদদপুষ্ট ছাত্রলীগ কর্তৃক ঘটানো হয়। পরে আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে উপাচার্যের পদ থেকে সরতে বাধ্য করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নিবন্ধক হামিদুর রহমান বাদি হয়ে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। পরে ওই বছর ৮ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৭তম ব্যাচের বিভিন্ন বিভাগের ১৩ ছাত্রের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেন আশুলিয়া থানার তদন্ত কর্মকর্তা মীর শাহীন শাহ পারভেজ। পরে আন্দোলনের মুখে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর করা হয়।
১৩ জন আসামি হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্র শফিউল আলম সেতু এবং অভিনন্দন কুন্ডু অফি, প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের আশিকুল ইসলাম আশিক, খান মোহাম্মদ রইস ও জাহিদ হাসান, দর্শন বিভাগের কামরুজ্জামান সোহাগ, ইশতিয়াক মেহবুব অরুপ এবং রাশেদুল ইসলাম রাজু, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের মাহবুব আকরাম, ইতিহাস বিভাগের মাহমুদুল হাসান এবং মাজহারুল ইসলাম, অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের নাজমুস সাকিব তপু এবং লোকপ্রশাসন বিভাগের নাজমুল হাসান প্লাবন।
এদিকে ১৩ জন আসামির মধ্যে ৬ জন খালাস পায়। বাকী ৭ জনের মধ্যে ২ জন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫ জনের ফাসিঁর আদেশ দেন আদালত। কিন্তু যেই ৭ জন দণ্ডপ্রাপ্ত তারা কেউ এখন দেশে নেই। জানা যায়, মালয়শিয়া, ডেনমার্ক ও সুইডেনে পলাতক রয়েছে।
এক যুগেও বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের আহ্বায়ক আলিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, “জুবায়ের হত্যাকান্ড জাবির ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। ছাত্রলীগের আক্রোশে জুবায়ের হত্যার শিকার হলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে ভিসি শরীফ এনামুল কবিরের পতন নিশ্চিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিভিন্ন হত্যাকান্ডের মধ্যে এটিই ছিলো
প্রথম রায় যেখানে হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ সাজা প্রদান করা হয়। কিন্তু সাজা কার্যকর করা হয়নি। ফলে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এখনও ক্যাম্পাসগুলোতে চলে অস্ত্রের ঝনঝনানি। সেই সময়ের আন্দোলন শিক্ষার্থীদের এখনোও আলো দেখায়। জুবায়ের হত্যাকারীদের দ্রুত সাজা কার্যকরের দাবি জানাই।”
তৎকালীন সময়ে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছিলেন। তাদেরই একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন।
শিক্ষক মঞ্চের আহ্বায়ক অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, “দেশের বিচারব্যবস্থা, রাজনীতি কিংবা শাসনব্যবস্থা সব তো এখন একাকার হয়ে আছে। সবকিছুতেই হচ্ছে একইরকম অবস্থা। এখানে ন্যূনতম ন্যায় বিচারের জায়গা নিশ্চিত হচ্ছে না।
সেখানে জুবায়ের হত্যার বিচার তো এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। যারা আসামি তাদের ধরে এনে শাস্তি দিবে এটা নিয়ে কেউ আসলে তাগাদা বোধ করছে না। অথচ এই বিচার হওয়াটা জরুরী ছিল। শিক্ষাঙ্গণে যতগুলো হত্যাকান্ড ঘটেছে তার কোনোটারই তো বিচার হয়নি। অন্তত এই বিচারটা আন্দোলনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে পেরেছিলাম কিন্তু সেটাও কার্যকর হলো না। এটা খুবই দুঃখজনক।”
তিনি আরো বলেন, “অন্যায্যতা আর বিচারহীনতা সর্বব্যাপী হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এখন আশা করার মতো তেমন কিছুই টিকে নাই।”