
এসএম মোফাজ্জল হোসেন: বাংলা ভাষা। আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের ভাষা ।বাংলা ভাষাতেই আমরা আমাদের মনের আবেগ, প্রেম ,ভালোবাসার কথা বলি,আবেগের কথা বলি।আমরা যখন কথাবলি তখন মনে হয় বাংলাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা। আমাদের ভাষায় এত ছন্দ,এত মধু এবং প্রাঞ্জল ভাষা পৃথিবীর কোথাও নাই। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা । একজন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে মা তাকে বাংলা ভাষার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। মা তাকে বাংলা ভাষার মাধ্যমে উজার করে দেয় তার সমস্ত ভালোবাসা। স্নেহ, মায়া মমতায় ভরে উঠে মায়ের দেহ মন।
আমাদের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা। পৃথিবীতে যতো দেশ আছে প্রত্যেকটি দেশের রাষ্ট্র ভাষা আছে অর্থাৎ যাকে বলে মাতৃভাষা। তারা যেমন তাদের মাতৃভাষায় ভাবের আদান প্রদান করেন, ঠিক আমরাও আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় ভাবের আদান প্রদান করি শুধু তাই নয়, আমাদের রাষ্ট্রের সকল রীতিনীতি, অফিশিয়াল যোগাযোগ বাংলা ভাষাতেই হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাদের রাষ্টীয় ভাষায় অফিশিয়াল যোগাযোগ, রীতিনীতি, নিয়ম-কানুন পরিপালন করতে হয়।তবে পৃথিবীর বিশাল জনগোষ্টির মাঝে বাংগালী এবং বাংলা ভাষা বিশেষ ভাবে পরিচিত। তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে, মনের আবেগকে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করে । পৃথিবীর কোন দেশ তাদের মাতৃ ভাষা,তাদের রাষ্ট্র ভাষা প্রতিষ্ঠা করতে আন্দোলন, মিটিং, মিছিল,হরতাল,অবরোধ সহ জান মালের ক্ষয় ক্ষতি করেছে কিনা আমার জানা নাই ,তবে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা নিয়ে, এ বাংলায় অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে, আন্দোলন ,মিটিং ,মিছিল ,হরতাল ,অবরোধ হয়েছে, কি হয়নি এ বাংলায়।ভাষার জন্য শহিদ হয়েছেন , ছালাম, রফিক , বরকত, জব্বার সহ অনেক ছাত্রনেতা এবং সাধারন জনগন । রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই, এই শ্লোগানকে বাস্তবে রুপ দিতে গিয়ে যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের অবদানকে এ জাতী কখনো ভুলে নাই,কখনো ভুলবে না তবে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেরুয়ারী কেন এতো গুরুত্বপুর্ন তা জানতে আমরা একটু পিছনে যাব-
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রথম প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়ালপিন্ডীতে এক জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় গুলিবিদ্ব হয়ে নিহত হন। পুর্ব বাংলার প্রধান মন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনকে তাঁর জায়গায় প্রধান মন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। আর পূর্ব বাংলার প্রধান মন্ত্রী পদে আসীন হন নুরুল আমীন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকায় আসেন ১৯৫২ সালের জানুয়ারী মাসের শেষ দিকে। ২৪, ২৫,ও২৬শে জানুয়ারী ঢাকায় পাকিস্হান মুসলীম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ।২৭শে জানুয়ারী পল্টন ময়দানে মুসলীম লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় এক বিরাট জনসভা। খাজা নাজিমুদ্দীন এ সভায় বক্তৃতা করেন । বক্তৃতায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রসংঙ্গে তিনি ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তৃতার কিছু অংশ উদ্বৃত করে বলেন যে, পুর্ব বাংলা প্রদেশের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা পূর্ব বাংলার জনগনই স্হির করবেন। তবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা একটিই হতে হবে এবং তা হবে উর্দু।
শুরু হলো আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ,দেয়ালে দেয়ালে পোষ্টার লাগানো, এবং ৩০শে জানুয়ারী ছাত্ররা ধর্মঘট আহবান করে ,তারপর ৪ঠা ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকার সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের ঘোষনা দেন । সভা সমাবেশে উত্তাল ঢাকা শহর,সমাবেশ শেষ করে ছাত্রদের প্রায় এক মাইল দীর্ঘ একটি মিছিল শহরের প্রধান প্রধান রাস্তা প্রদক্ষিন করে । মিছিলে অংশগ্রহনকারী ছাত্ররা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” আরবি হরফ চলবে না” নাজিমুদ্দীন গদি ছাড়ো” ইত্যাদী শ্লোগান দেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সভার পরই পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কাজী গোলাম মাহবুব ৩১শে জানুয়ারী ঢাকার বার লাইব্রেরী হলে একটি সর্ব দলীয় সভা আহবান করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে ৩১শে জানুয়ারী তারিখে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতা কর্মীরা এ সভায় যোগদান করেন। সেইদিন বার লাইব্রেরী হলে কাজী গোলাম মাহবুবকে আহবায়ক করে ৪২ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংরাম কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন , মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম, আতাউর রহমান খান, কমরদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, মহম্মদ তোয়াহা, অলী আহাদ, আব্দুল মতিন,খালেক নওয়াজ খান প্রমুখ
লাইব্রেরী সভায় একটি প্রস্তাবে খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টনের সভায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার যে বত্তব্য প্রদান করেন, তার নিন্দা করা হয় এবং অবিলম্বে সেই অগণতান্ত্রিক ঘোষনা প্রত্যাহার করার দাবি জানানো হয়। আরবি হরফ প্রচলনের চক্রান্তের বিরুদ্ধেও একটি প্রস্তাব গৃহিত হয়। তাছাড়া সভায় ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের প্রতিও সমর্থন জানানো হয়।
৩১শে জানুয়ারী,১৯৫২ তারিখে সদ্য গঠিত সর্বদলীয রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’এর সভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি গৃহিত হয়েছিল;
০১। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই সভা ১৯৪৮ সালে পুর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও জনগনের সহিত নিজের চুক্তি লংঘন করিয়া প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা বলিয়া সম্প্রতি ঢাকায় যে বক্তৃতা প্রদান করিয়াছেন তাহার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও নিন্দা ব্যক্ত করিতেছে।
সেই হিসাবে এই সভা খাজা নাজিমুদ্দিনকে তাঁহার অগণতান্ত্রিক ও অযাচিত ঘোষনা প্রত্যাহার করিবার জন্য দাবী জানিয়েছেন।
০২। বাংলা ভাষাকে হত্যার আর একটি চক্রান্ত হিসাবে বাংলায় আরবী অক্ষর প্রচলনের জন্য এই সভা সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা করিতেছে।
০৩। ঢাকা শহরে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সাধারন ধর্মঘট করিবার যে সিদ্ধান্ত ঢাকার ছাত্ররা গ্রহন করিয়াছে এই সভা তাহার প্রতি সমর্থন জানাইতেছে।
০৪। এই সভা প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা হইবে পাকিস্তানের সংখ্যা গুরু জনগনের রাষ্ট্রভাষা ; আর পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের জনগন যদি উর্দুকে তাহাদের সাধারন ভাষা বলিয়া স্বীকার করেন তাহা হইলে উর্দুও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হইবে।
০৫। এই সভা অবিলম্বে নিরাপত্তা বন্দী শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য আটক বন্দীর মুক্তি এবং জননিরাপত্তা আইন প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।
৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহর সহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলিতে সর্বাত্নক ধর্মঘট পালিত হয় । ধর্মঘটের পর ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয প্রাঙ্গনে এক সভায় সমবেত হন । এ সভায় সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটিকে ’ সর্বদলীয রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’র একটি অঙ্গ হিসেবে ঘোষনা করা হয়। এই সভাতেই ২১শে ফেফ্রয়ারী সারা পুর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দবিতে সাধারন ধর্মঘট পালনের সিদ্বান্ত গৃহিত হয় । ২১শে ফেব্রুয়ারি নির্ধারনের কারন ছিলো পুর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন শুরুর তারিখের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করা। এর আগেই সরকারী ভাবে ঘোষনা করা হয়েছিল যে, ২০ শে ফেব্রুয়ারি পুর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন শুরু হবে।
৪। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সদস্যগণ বেশ কয়েকটি সভায় মিলিত হয়ে পরিস্থিতি সম্পর্কে মতামত বিনিময় এবং পরবর্তী কর্মপন্হআ নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন। এই সভাগুলি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৫০, মোগলটুলী এবং ১৪, নবাবপুর রোডে।(ইতিহাসে বাংলাদেশ,পৃষ্ঠা২৩৬হতে)
তারপর অনেক কথা,রাষ্ট্রভাষা চালু করতে পশ্চিম পাকিস্হানের সাথে আমাদের বিরোধ দিনের পর দিন বাড়তেই থাকে ।পশ্চিম পাকিস্তানের বিখ্যাত দৈনিক ইংরেজী পত্রিকা ডন, বাংলার রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সম্পাদকীয়তে বিস্তর লেখালেখী করে এবং পুর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষাকে অবজ্ঞা এবং ঘৃণিত ভাবে দেখা শুরু করে। বাংলার দামাল ছেলেরা এবং এ দেশের সর্বস্তরের জনগনের অনেক ত্যাগ এবং তিতিক্ষার বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যুগ যুগ ধরে এ বাংলায় পালিত হয়ে আসছে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি।এ মাস আমাদের ভাষার মাস,তাই আমরা প্রতি বৎসর স্মরন করি, ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন সেই অমর একুশের প্রান শহিদ সালাম ,রফিক, বরকত,জব্বার সহ নাম না জানা অমর শহিদদের। তাঁদের স্মৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ করছি , আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমি কি ভুলিতে পারি।