
দেশে এখনো বাল্যবিবাহ একটি গভীর সামাজিক সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএ’র বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই।
শুধু তাই নয়, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী প্রতি হাজার কিশোরীর মধ্যে ৭১ জন এক বা একাধিক সন্তানের মা হয়ে যাচ্ছে। এই চিত্র দেশের প্রজনন স্বাস্থ্য ও কিশোরীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
২০২৫ সালের বৈশ্বিক জনসংখ্যা পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি ইউএনএফপিএ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে বিশ্বব্যাপী প্রজনন স্বাস্থ্য, প্রজনন অধিকার ও পরিবার পরিকল্পনার সুযোগ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনসংখ্যা কম বা বেশি— এই বিতর্কের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, একজন ব্যক্তি তার নিজের প্রজনন লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে কিনা।
লাখো মানুষ এখনো তাদের পছন্দের প্রজনন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কিংবা তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই সীমাবদ্ধতা সমাজে জেন্ডার বৈষম্য ও স্বাস্থ্যঝুঁকির বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ১০ শতাংশ দম্পতি প্রয়োজনের সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পায় না। এই ঘাটতির কারণে অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণ বেড়ে যাচ্ছে; যা নারীস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি দেশের ৭০ শতাংশ নারী সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় কোনো দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পায়; যার অর্থ ৩০ শতাংশ প্রসব হচ্ছে অদক্ষ বা প্রশিক্ষণবিহীন মানুষের উপস্থিতিতে।
এতে মা ও শিশুর জীবনের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। মাতৃমৃত্যুর হারও উদ্বেগজনক। প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে প্রতি এক লাখ নবজাতকের পেছনে ১১৫ জন মা মৃত্যুবরণ করেন। অনেক উন্নত দেশে এই হার মাত্র এক বা দুই।
নারীর প্রতি সহিংসতা ও অধিকার লঙ্ঘনের চিত্রও এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের ২৩ শতাংশ নারী বলেছেন, বিগত এক বছরে তারা তাদের স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এই চিত্র সমাজে নারী অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্নে গুরুতর সংকেত বহন করে।
বাল্যবিবাহ ও কিশোরী মাতৃত্ব বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক সংকট। আফ্রিকার কিছু দেশ ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও বাংলাদেশের মতো এত বেশি বাল্যবিবাহের হার নেই। এর পরিণতি সরাসরি কিশোরীদের ওপর পড়ে— তারা অল্প বয়সে গর্ভধারণ করে, অনেক সময় নিজ শরীর ও মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই মা হয়ে যায়। এতে তাদের মৃত্যুঝুঁকি, প্রসবজনিত জটিলতা ও শিশু মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। এই দুষ্ট চক্র থেকে দেশ এখনো পুরোপুরি বের হতে পারেনি।
তবে ইউএনএফপি’র প্রতিবেদনে কিছু আশাব্যঞ্জক দৃষ্টান্তও তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, মধ্য আমেরিকার দেশ ডমিনিকান প্রজাতন্ত্রে ২০১৩ সালে প্রতি হাজার কিশোরীর মধ্যে ৯০ জন গর্ভধারণ করত; যা ২০১৯ সালে নেমে আসে ৭৭ জনে। ইউএনএফপিএ মনে করে, বর্তমান হার আরো কম। দেশটি বাল্যবিবাহ ও কিশোরী মাতৃত্ব কমাতে সরকারি উদ্যোগ, জনসচেতনতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে। সেখানে ইউএনএফপিএরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল। মেয়েদের শিক্ষার হার বেড়েছে, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সহজলভ্য হয়েছে এবং সমাজের মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশের জন্য এটি হতে পারে একটি অনুকরণীয় উদাহরণ।
প্রতিবেদনটি শুধু কিশোরী নয়, বরং দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর চিত্রও তুলে ধরেছে। বলা হয়েছে, এখন থেকে ৫০ বছর আগেও বিশ্বে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৯ বছর, আর বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭৩ বছর। বাংলাদেশের মানুষ গড় আয়ুতে বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও এগিয়ে— পুরুষদের গড় আয়ু ৭৪ বছর, নারীদের ৭৭ বছর।
তবে এই দীর্ঘায়ু নতুন চ্যালেঞ্জও নিয়ে এসেছে। দেশের প্রায় সাত শতাংশ মানুষের বয়স এখন ৬৫ বছরের বেশি; যা সংখ্যায় প্রায় এক কোটি ২৩ লাখ। এদের অধিকাংশই অন্যের আর্থিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি এই বয়সী মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, ক্যানসার ও দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগের প্রকোপ বেশি।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রবীণদের জন্য বিশেষ সেবা ও পণ্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, থাইল্যান্ড ও ব্রাজিলে এমন অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেগুলো প্রবীণদের মানসম্পন্ন জীবনযাপনে সহায়তা করছে। বাংলাদেশেও এই জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে বিশেষ নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
অতীতে বাংলাদেশকে বলা হতো ‘জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দেশ’। তখন একজন নারী গড়ে পাঁচ সন্তানের জন্ম দিতেন। কিন্তু বর্তমানে এই চিত্র পাল্টে গেছে। ইউএনএফপিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন দেশে মোট প্রজনন হার দুই দশমিক এক; যা প্রতিস্থাপন পর্যায়ের হার। এই হার বজায় থাকলে জনসংখ্যা বাড়ে না, কমেও না— স্থির থাকে। তবে বিশ্ব এখন নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি— জনসংখ্যা পতন। অনেক দেশে সন্তান জন্মহার এতটাই কমে গেছে যে, ভবিষ্যতে জনসংখ্যা ধরে রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
তরুণ জনগোষ্ঠীর প্রসঙ্গেও প্রতিবেদনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্বের তরুণরা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তারা মনে করে, আগের প্রজন্মের তুলনায় তারা আরো অনিশ্চিত, সুযোগবঞ্চিত এবং বৈষম্যের শিকার। অনেক তরুণ মনে করেন, তাদের স্বপ্ন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের হতাশা ও ক্ষোভ নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ দেওয়ার দাবি রাখে।
জনসংখ্যাবিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, দেশে মোট প্রজনন হার কমে আসা নিঃসন্দেহে দীর্ঘমেয়াদি একটি সাফল্য। তবে এ কথাও ঠিক যে প্রতিবছর আমাদের শ্রমবাজারে ২০ থেকে ২২ লাখ নতুন মানুষ প্রবেশের উপযুক্ত বয়সে পৌঁছায়। কিন্তু তাদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক মানুষই কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের বেকারত্বের হার বেশি। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগোতে হলে আমাদের যুব জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা, প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন এবং সুস্বাস্থ্যের ওপর আরও জোর দিতে হবে।