রেজাই রাব্বী: পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অনুভূতি ও মধুরতম ডাক ‘মা’। ‘মা’ শব্দটি সবার প্রিয়। ছোট্ট এই শব্দের অতলে লুকানো থাকে গভীর স্নেহ, মমতা আর অকৃত্রিম দরদ। তাইতো মমতাময়ী মায়ের সম্মানে প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার ‘বিশ্ব মা দিবস’ পালন করা হয়। আজ (১২ মে) রোববার বিশ্ব মা দিবস। ভ্রুণ থেকে দশটি মাস গর্ভে ধারণ করে যে মা সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখান, সেই মায়ের সম্মানে তারই চরণে আজকের এ দিনে নত তাবৎ পৃথিবীর সন্তানেরা।
কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবেন বা তুলেছেন, মাকে ভালোবাসতে দিবসের প্রয়োজন আছে কি না, কিংবা মাকে ভালোবাসতে কোনো নির্দিষ্ট দিনের প্রয়োজন আছে কি না। তাদের প্রশ্নও হয়তো অবান্তর নয়। হ্যাঁ, মাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে কোনো দিনক্ষণ প্রয়োজন হয় না। কিন্তু, মা দিবস পালনে তো কোনো ক্ষতি নেই। মায়ের জন্য প্রতিদিনই সন্তানের ভালোবাসা থাকে। তবুও আলাদা করে একটু ভালোবাসা জানাতেই আজকের দিনটি।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন ‘যার মা আছে, সে কখনো গরিব নয়’।
আমাদের মতো মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা জানে লিংকনের কথা কতটা সত্যি। আমরা জানি আমাদের জীবনে মায়ের অবদান কতটুকু। কীভাবে সংসারের খরচ থেকে অল্প অল্প করে জমানো টাকা তুলে দেন সন্তানের হাতে। তাও গোপনে, আব্বুর অজান্তে।
সকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভরে গেছে মায়েদের ছবিতে। আমরাতো সামাজিক মাধ্যমে প্রতিদিন কতকিছু পোস্ট করি। একদিন যদি এভাবে সবাই মায়ের ছবি পোস্ট করি, তাহলে দেখতে ভালোই লাগে।
এবার আমার মায়ের একটি গল্প বলি। যদিও বলে শেষ করা যাবে না, তবুও একটা বলা যাক। নিজ শহরের (সিরাজগঞ্জ) স্কুল থেকে এসএসসি পাস করলাম। তারপর কলেজে ভর্তি হই। একসময় এইচএসসি ও পাস করলাম। এরপর আব্বু-আম্মুর সম্মতিতে শুরু হলো ভর্তি যুদ্ধ। ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে সুযোগ হলো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সরকারি তিতুমীর কলেজে। সময় হলো বাড়ি ছাড়ার। তারপর গ্রাজুয়েট হওয়ার জন্য সিরাজগঞ্জ ছেড়ে চলে আসতে হবে রাজধানীতে। একসময় ভাবতাম কবে থেকে যে আর পরিবারের সব বিধিনিষেধ থাকবে না, কবে থেকে চলবো নিজের মতো করে!
একদিন এমন দিন সত্যিই চলে এল। এক দিকে মনে ছিল খুশি কারণ থাকবে না কোনো বাধা বিপত্তি, কারো কোনো কথা শুনতে হবে না, নিজের মতো চলাফেরা করা যাবে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা হতো, বাড়ি থেকে পালিয়ে দূরে কোথাও চলে যাই এখন যেন তা বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। অন্যদিকে ছিল মন খারাপ কারণ পরিবার ছেড়ে একা থাকতে হবে। কখনো বাইরে থাকা হয়নি। এর কিছু দিনের মধ্যেই দেখতে দেখতে চলে এলো বাড়ি ছাড়ার দিন। আব্বু আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে গেলেন। চলে এলাম রাজধানীতে। এরপর শিক্ষাঙ্গনে ভর্তি হলাম। মেসে একা থাকার জীবন শুরু হলো। শুরুতে প্রতি মাসেই বাড়িতে যেতাম। ধীরে ধীরে তা কমে গেল। ক্লাস এবং অফিসের কাজ সব মিলিয়ে এখন ৩ মাস পর একবার বাড়ি যাওয়া হয়। আর এখন বাড়ি গেলেও থাকার সুযোগ হয় মাত্র ৩ দিন। তবে বাড়ি যাওয়া হয় সচরাচর রাতে, তো যে রাতে বাড়ি যাই মা সেই রাতে আর ঘুমায় না আমি বাড়ি না যাওয়া পর্যন্ত। আর ৩ ঘন্টার রাস্তায় ফোন করে কমপক্ষে ৮/৯ বার। তবে আমি খুব একটা বাড়ি না গেলেও অনেক সময়ই কোনো না কোনো ভাবে মা আমার জন্য বাড়ি থেকে খাবার রান্না করে পাঠান। কিন্তু কিছু দিন আগে আমি যে কথাটি জানতে পেরেছিলাম, তাতে আমি পুরোই অবাক ও হতভম্ব হয়ে যাই। সেদিন জানতে পারি, আমার মা বড় মাছ বা মাংস খেতে দ্বিধা বোধ করতো। কারণ আমি মেসে থাকি মায়ের ধারণা ছিল মেসে ভালো খাওয়া-দাওয়া হয় না। তাই মাছ-মাংস খেতে গেলে আমার মুখটা মায়ের চোখে ভেসে উঠত। তাই তিনি খেতে পারতেন না। এটা জানার পর সেদিন আমি কিছুই বলতে পারিনি। আজ শুধুই বলব, ‘ভালো থেকো মা।’
এখন এই বিষয় গুলো হৃদয়ে নাড়া দেয়। প্রতিটি সময়ই মনে পড়ে মা-বাবাকে। যারা বিদেশের বাড়িতে একাকী বা মা-বাবা ছাড়া সন্তানাদী নিয়ে বসবাস করেন তারাও ভাবেন। ভাবনার মধ্যে সময় কাটান। তবুও দূরেই থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে থেকেও আমাদের অনেকেরই মা বাবা ছাড়া থাকতে হয়। কারো বাধ্য হয়ে অথবা কেও-বা ইচ্ছা করেই।
এই গল্পটা শুধু আমার একার নয়। আমাদের সবার জীবনের গল্প, সবার সঙ্গেই হয়তো এমন কিছু ঘটে। কারণ, সন্তানের জন্য মায়েদের ভালোবাসায় পার্থক্য থাকে না।
“মার মতো হয় না কারো
নরম কোমল মন,
মা হলেন এ ধরণির
সবার আপনজন।”
যাইহোক, আজ মা দিবস। সব সন্তানেরই মায়ের জন্য একটাই প্রার্থনা, ‘ভালো থেকো মা।
ডেইলি ঢাকা প্রেস/রেজাই রাব্বী/১২ মে,২০২৪