মোঃ আসিফ: চাকরির ভাইভা শেষ করে বের হলাম। এ চাকরিটাও হবে না বুঝতে পারলাম। কত তম ভাইভা দিলাম ঠিক মনে পড়ে না। আসলে গত দুই বছর ধরে এত ভাইবা দিয়ে যাচ্ছি যে হিসাব রাখা কঠিন। সিদ্ধান্ত নিলাম আর কোন পরীক্ষা দেবো না। এই ব্যর্থতার বোঝা আর বয়ে বেড়াবো না। ব্যর্থতার বোঝা বয়ে বেড়ানোর চেয়ে পৃথিবী থেকে স্বসম্মানে বিদায় নেওয়া অনেক ভালো। পরিবারের কথা চিন্তা করলাম। তারা এত কষ্ট করে বড় করেছে। বড় হওয়ায় এখন তাদের প্রতি কত দায়িত্ব আমার। কিন্তু কিছু করার নেই।
আমি একজন ব্যর্থ সন্তান। হাতের মোবাইলটাকে পুকুরে ছুড়ে ফেলে দিলাম। সার্টিফিকেট গুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেললাম। সিদ্ধান্ত নিলাম মরেই যখন যাবো তখন এই পৃথিবীটাকে আর একটা দিন ঘুরে দেখে যাই। পকেটে খুব বেশি টাকা নেই। বাসস্ট্যান্ডে এসে একটা বাসে উঠে পড়লাম। কোথাকার বাস আমি জানি না। আমার গন্তব্য কোথায় তাও জানিনা। শরীর ক্লান্ত হাওয়ায় বাসের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। এটাই হয়তো জীবনের শেষ ঘুম। হঠাৎ কারো ধাক্কায় ঘুম ভেঙে গেল।
কন্ট্রাকটর বলছে মামা নামবেন না? কেন? তোমার বাস কি আর যাবে না? না মামা এটাই শেষ গন্তব্য। বাস থেকে নেমে পড়লাম। কোথায় নামলাম তাও জানিনা। রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। অনেকক্ষণ হাঁটার পর প্রধান রাস্তার সাথে একটা সরু রাস্তা দেখতে পেলাম। সরু রাস্তাটা সম্ভবত গ্রামের দিকে গেছে। সরু রাস্তাটা ধরে হাঁটতে লাগলাম। প্রকৃতি কত সুন্দর! কত সুন্দর এই পৃথিবীটা! কিন্তু এত সৌন্দর্য আমার কাছে ব্যর্থতার চাদরে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে গ্রামের ভিতর প্রবেশ করলাম। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখলাম একটা গাছের নিচে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ দেখে কৌতুহল নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম। লোকের ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে দেখলাম আমার বয়সের একটা ছেলে গলায় ফাঁসি দিয়ে গাছের সাথে ঝুলে আছে।
ছেলেটার দিকে কিছুক্ষণ উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। কাল হয়তো আমিও কোথাও এভাবে ঝুলে থাকব। এটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আহারে জীবন! একজনের থেকে ছেলেটার আত্মহত্যার কারণ জানতে পারলাম। গতকাল রাতে তার প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেছে। সেজন্য সে এখন গাছে ঝুলছে। তার প্রেমিকা কি তার মৃত্যুর খবরটা পেয়েছে? হয়তো পেয়েছে। সে এখন কি করবে? হয়তো দুই- এক ফোঁটা চোখের জল ফেলবে। এর থেকে বেশি কি কিছু করবে? আমার মনে হয় না। ছেলেটাকে বাহবা দেব, নাকি বোকা বলব এটা বুঝতে না পেরে সেখান থেকে চলে আসলাম। হাঁটতে হাঁটতে বাজারে চলে আসলাম।
একজন অন্ধ ব্যক্তিকে ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে ভিক্ষুক ভেবে তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে চলে আসছিলাম। হঠাৎ তিনি পিছন থেকে ডাক দিলেন- বাবা আপনি আমাকে কিসের টাকা দিলেন? আপনি একজন অন্ধ মানুষ তাই আপনাকে একটু সাহায্য করলাম। বাবা আমি তো ভিক্ষুক না। আমি অন্ধ হলেও আমি ভিক্ষা করি না। এই বাজারে আমি ছাতা সাড়ানোর কাজ করি। রাস্তা পার হওয়ার জন্য এখানে দাড়িয়ে আছি। তিনি আমাকে টাকা গুলো ফেরত দিলেন। এমনি তাকে দিয়ে দিতে চাইলেও তিনি নিলেন না। তাকে রাস্তা পার করে দিয়ে তার সাথে-সাথে গেলাম। একটু পর তিনি তার কাজ শুরু করলেন। তার পাশে বসে কিছুক্ষণ কথা বললাম। জানতে পারলাম- তার বৃদ্ধ মা সহ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয় জন।
তিনি একাই উপার্জন করেন। অভাব অনাটনে দিন কাটলেও তিনি সুখে আছেন। তিনি জীবন যুদ্ধে হার না মানা একজন সৈনিক। তার কথা শেষ হতেই নিজের কথা ভাবলাম। আমি তো তার থেকে অনেক ভালো অবস্থানে আছি। তার দৃষ্টি শক্তি নেই। কিন্তু আমার আছে। অথচ কত সহজেই আমি হার মেনে নিচ্ছি। গতকাল যে ছেলেটা আত্মহত্যা করেছে সেও তো এই অন্ধ ব্যাক্তির চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল। সেও কত সহজে হার মেনে নিছে। যাইহোক এইসব কথা ভাবা যাবে না। তাহলে আমি আমার রাস্তা থেকে সরে আসতে পারি। না, এই ব্যর্থতার বোঝা আমি আর বয়ে বেড়াতে চাই না। লোকটা আমার পরিচয় জানতে চাইলো। আমি পরিচয় না দিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। বাজারটা অনেক বড় বাজার।
বাজারের এক পাশে কামারদের দোকান। কামারদের দোকানের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা জায়গায় আমর চোখ আটকে গেল। একজন কামার হাতুড়ি দিয়ে জ্বলন্ত লোহাকে পেটাচ্ছে। কিন্তু তার একটা হাত নেই। এক হাত দিয়েই তিনি হাতুড়ি চালাচ্ছেন। তার কাছে এগিয়ে গেলাম। তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম। তার থেকে জানতে পারলাম- প্রায় বছর সাতেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তার একটা হাত কাটা পড়েছে। সাত বছর যাবত তিনি এক হাত দিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন। এক হাত দিয়ে কাজ করতে তার অসুবিধা হয় কিনা, তাকে জিজ্ঞেস করলাম? তিনি বললেন- বেঁচে আছি এটাইতো বেশি। একটা হাতের জন্য এত অভিযোগ করার কি দরকার। এক হাত দিয়ে সংগ্রাম করে তিনি তার পরিবার চালাচ্ছেন।
গতকাল যে ছেলেটা আত্মহত্যা করেছে, সে তো এই লোকের চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল। তারপরও ছেলেটা কত সহজেই হার মেনে নিয়েছে। আমিও তো এই লোকের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছি। আমার হাত, পা, চোখ সবই ভালো আছে। তারপরও কত সহজেই হার মেনে নিচ্ছি। না, এই গ্রামে আর আমার থাকা যাবে না। এখানে থাকলে আর আমার আত্মহত্যা করা হবে না। আত্মহত্যা না করলে আমার এই ব্যর্থতার বোঝা বয়েই বেড়াতে হবে। এই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য রেলস্টেশনে চলে আসলাম। কিন্তু স্টেশনে এখন কোনো ট্রেন নেই। সন্ধ্যার পরে ট্রেন আছে। তাই সেখানে অপেক্ষা করতে থাকলাম। কোথায় গিয়ে আত্মহত্যাটা করবো ঠিক করতে পারছিলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেন যেখানে শেষ থামবে, সেখানেই আত্মহত্যাটা করবো।
স্টেশনে বসে অতীত জীবনের কথা ভাবছিলাম। এমন সময় ৬/৭ বছরের একটা ছেলে এসে আমার কাছে টাকা চাইলো। পড়নে নোংরা জামাকাপড়। তার থেকে জানতে পারলাম- সে তার মা সহ এই স্টেশনেই থাকে। তাদের কোনো ঘরবাড়ি নেই। তার মা সারাদিন বাসাবাড়িতে কাজ করে। রাত হলে তারা এই স্টেশনেই ঘুমায়। দুপুরে নাকি ছেলেটা কিছুই খায়নি। বিকেল বেলা তার মা কিছু খাবার নিয়ে আসলে খাবে। ছেলেটাকে কিছু টাকা দিলাম। সন্ধ্যার দিকে দেখলাম ছেলেটার মা কিছু খাবার এনে তার ছেলেকে খাওয়ালেন। পলিথিনে মোড়ানো অল্প কিছু ভাত- তরকারি। হয়তো সারাদিন কাজ করায় গৃহকর্তি মহিলাকে কিছু খেতে দিয়েছিলেন।
কিন্তু মহিলা নিজে না খেয়ে পলিথিনের মুড়িয়ে খাবার গুলো এনে ছেলেকে খাওয়ালেন। সন্ধ্যার পরপরই মা-ছেলে ঘুমিয়ে পড়লেন। স্টেশনের শক্ত মেঝে, লোকজনের এত কোলাহল কিছুই যেন তাদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না। অথচ আমরা নরম বিছানায় শুয়েও এভাবে ঘুমাতে পারি না। এদের চেয়ে আমরা কত ভালো অবস্থানে আছি তারপরও আমাদের জীবন দিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। চিন্তা করতে থাকলাম এভাবে হেরে গেলে চলবে না। নিজের জন্য না হোক, নিজের পরিবারের জন্য, এসব অসহায় মানুষদের জন্য হলেও বাঁচতে হবে। আমার মাও তো আমাকে এভাবে কষ্ট করে বড় করেছে।
তাহলে কিভাবে তাদের ছেড়ে আমি চলে যাচ্ছি। নাহ, আমকে বাঁচতে হবে। ভালো কিছু করতে হবে। আত্মহত্যার চিন্তা বাদ দিলাম। একটু পর ট্রেন আসলো। ট্রেনে করে বাসার দিকে চলে আসলাম। মনে মনে ঠিক করলাম জীবনে পাওয়া না পাওয়া নিয়ে আর কোন আক্ষেপ করব না। যা পাবো তাতেই সন্তুষ্ট থাকব। আমি আর চাকরির পিছনে ছুটবো না। এমন কিছু করব যাতে আমিই মানুষকে চাকরি দিতে পারি। এক বড় ভাইয়ের সহযোগিতা নিয়ে অল্প কিছু পুঁজি দিয়ে ব্যবসা শুরু করলাম। কঠোর পরিশ্রম করতে লাগলাম।
এখন সবসময় সেইসব হার মানা যোদ্ধাদের কথা মনে করি। যারা শত বাধা উপেক্ষা করেও জীবনের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। বহুদিনের কঠোর পরিশ্রমের ফলে আজ আমি বিশাল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। আমার প্রতিষ্ঠানে আজ হাজার হাজার মানুষ কাজ করছে। সেদিন আত্মহত্যা করলে হয়তো আজকের এই সফলতা পেতাম না। আজ বুঝতে পারছি সেদিন যে ছেলে আত্মহত্যা করেছিল সে সবচেয়ে বড় বোকা ছিল। পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় সফলতা।
মোঃ আসিফ
ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়