ঢাকা : কাজে যাওয়ার সময় দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন অ্যানি বেগম। মায়ের কারখানার পাশে খোলা জায়গায় খেলাধুলা করত তারা। একদিন খেলতে খেলতে বড় ভাই আরিয়ানের পিছে পিছে আমগাছের নিচে যায় রায়হান। আমগাছের গোড়ায় লাগানো বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা যায় শিশু দুটি।
বিষয়টি নিয়ে বেশ সমালোচনা হয়। শিশু দুটির বাবা বিচারের আশায় থানায় মামলা করেন। কিন্তু, এখন আর দোষীদের বিচার চাচ্ছে না পরিবারটি। তারা আসামিপক্ষের সঙ্গে আপস করেছেন। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২ লাখ টাকায় আপস করেছে পরিবারটি।
গত ১২ এপ্রিল দুপুরে রাজধানীর ডেমরার বামৈল পশ্চিম পাড়া ব্যাংক কলোনির মরহুম ইসমাইল মুহুরির বাড়িতে আমগাছের নিচে খেলতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আরিয়ান ও রায়হানের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় শিশু দুটির বাবা ভ্যানচালক মারফত মিয়া সাতজনের নাম উল্লেখ করে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে ডেমরা থানা পুলিশ। পুলিশ মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করেছে।
হত্যা মামলা তদন্ত করছে পুলিশ। মামলা দায়েরের পর আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়। তবে, সব আসামি এখন জামিনে আছেন। গত ২৮ আগস্ট এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু, ওই দিন পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তাহমিনা হকের আদালত আগামী ১১ অক্টোবর প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন।
শিশু দুটির বাবা মারফত মিয়া বলেছেন, ছেলে দুটি মারা যাওয়ার পর আমি মামলা করি। মামলা দায়েরের পর এলাকার কয়েকজন আমাকে ধরেছে আপস করার জন্য। বলছে, একটা সমাধান করতে। তারা আমাকে ২ লাখ টাকা দেবে। আমার ওয়াইফের কাছে মাফ চাইছে। এখন অন্যের সংসার নষ্ট করে কী লাভ?
তিনি বলেন, আমি মামলা করতে চাইনি। কয়েকজন ধরে আমাকে দিয়ে মামলা করিয়েছে। মামলা করেছিলাম দোষীদের শাস্তির জন্য। কিন্তু, আমরা তো গরিব মানুষ। মামলা চালানোর টাকা পাব কই? তাই, আপসের জন্য কোর্টে গিয়েছিলাম। আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে। সবকিছু আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।
বাদীপক্ষের সহায়তাকারী আইনজীবী আব্দুল কাদের বলেন, এলাকার একজন আমাকে ধরে বলে, ভাই, আপনি তো অনেকের উপকার করেন; এদেরও একটু সাহায্য করেন। এরা গরিব মানুষ। তাই, আমি তাদের পক্ষে মামলা লড়ছি। কিন্তু, তারা এখন লোভে পড়েছে। শুনেছি, টাকার বিনিময়ে আপস করেছে। এক আসামির জামিনের বিষয়ে শুনানির দিন বাদী আদালতে এসে বলে, জামিন দিলে আপত্তি নেই। বিষয়টি নিয়ে সিএমএম স্যার ক্ষিপ্ত। তার নলেজে এটা আছে।
তিনি বলেন, এটি হত্যা মামলা। এখানে সাধারণত আপসের সুযোগ থাকে না। মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হোক। বিচার শুরু হলে হয়ত আসামিদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে। দেখা যাক, কী হয়। তবে, এটুকু বলব, দুটি অবুঝ শিশুর প্রাণের মূল্য টাকা হতে পারে না। শুনেছি, তারা ২ লাখ টাকা নিয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডেমরা থানার উপ-পরিদর্শক সাইদুর রহমান বলেন, প্রথমে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলাটি করা হয়। পরে আমরা মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরের আবেদন করি। সে হিসেবে মামলার তদন্ত চলছে। ঘটনায় জড়িত এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার করি। বাদী আমাদের সাথে তেমন যোগাযোগ করেন না। শুনেছি, বাদীর সাথে আসামিদের আপস হয়েছে। তবে, আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করব।
কবে নাগাদ আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, এটা তো নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে আশা করি, মাসখানেকের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।
আসামিপক্ষের আইনজীবী হাবিবুল্লাহ খান বাবুলের কাছে আপসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এটা জানি না। তারা গরিব মানুষ। টাকা নিতেও পারে। হত্যা মামলায় আপসের সুযোগ আছে কি না? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হত্যা মামলায় সাধারণত আপসের সুযোগ নেই।
দুই সন্তানের মৃত্যুর ঘটনায় ১২ এপ্রিল দায়ের করা মামলায় মারফত মিয়া বলেন, তিনি ভ্যানচালক। তার স্ত্রী অ্যানি বেগম ডেমরা থানাধীন বামৈল ব্যাংক কলোনি সাধুর মাঠ সংলগ্ন ছাতার কারখানায় কাজ করেন। তার স্ত্রী প্রতিদিন বড় ছেলে আরিয়ান (৮) ও ছোট ছেলে রায়হানকে (২) সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে যান।
কারখানার আশপাশে খোলা জায়গায় তার দুই ছেলে খেলাধুলা করে। ১২ এপ্রিল সকাল ৮টার দিকে দুই ছেলেকে নিয়ে কারখানায় যান অ্যানি বেগম। কারখানার পাশে এক বাড়ির সামনে আমগাছের নিচে খেলতে গিয়ে গাছের গোড়ায় লাগানো বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে মারা যায় শিশু দুটি।
মারফত আলী অভিযোগ করেন, বাড়ির মালিকের স্ত্রী জাহানারা বেগম (৬৫), ছেলে শহিদুল ইসলাম টিপু (৪৫) ও জাহিদুল ইসলাম টিপু (৩৮), মেয়ে নিপা আক্তার (৪০) ও সারা বিনতে ইসমাইল (৩০) এবং নিপার স্বামী এ কে এম শাহ আলম তাদের গাছের আম চুরি রোধ করার জন্য গাছের গোড়ায় বৈদ্যুতিক তার জড়িয়ে রেখেছে।
ওই তারে জড়িয়ে এর আগে একটি কুকুর মারা যায়। তারপরও তারা বিদ্যুতের তার না সরিয়ে আমগাছে জড়িয়ে রাখে। মৃত্যুর ঝুঁকিসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে জেনেও আসামিদের ইচ্ছাকৃত এমন তাচ্ছিল্যপূর্ণ কাজের কারণে তার দুই ছেলের মৃত্যু হয়েছে।