সৈয়দ মনির আহমদ :
ফেনীতে ভূয়া ঠিকানা ব্যবহার করে এক রোহিঙ্গা দম্পতির বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ ও পাসপোর্ট বানাতে সক্রিয় একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। এতে জড়িত ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও কাজীসহ সৌদি প্রবাসি একটি চক্র। ওই দম্পতির নাম ইব্রাহীম(৩৪) ও সাদিয়া(৩৩)। গত ২২জুলাই টেকনাফ সদরের কাজী রাগেবুল হকের অফিসে তাদের বিয়ে হয়। ওই দম্পতির দুটি এনআইডি তৈরি করতে গত ৩ জুলাই ফেনী সদর নির্বাচন অফিসে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করা হয়েছে। আবেদনের সাথে জমা দেন, ঢাকা মহানগর (উত্তর) এর মিরপুর ৪নং জোনাল অফিসে নিবন্ধিত দুটি জন্মসনদ, দুটি পুরাতন পাসপোর্টের কপি, টেকনাফ সদরের একটি কাবিনের কপি, টেকনাফের ৪নং সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নুর হোসেন স্বাক্ষরিত ওয়ারিশসনদ, ফেনী সদরের ৬নং কালিদহ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন’র প্রত্যায়ন, ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বারের সত্যায়ন, ফেনীর বাঁশপাড়ার একটি বিদ্যুৎ বিল(মিটার নং ১০১০৮৫৩৭), ফেনীর কালিদহ ইউনিয়নের যাত্রাসিদ্দি মৌজার দুই শতাংশ জমির দলিলের কপি ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, জেদ্দা কনস্যুলেটের একটি প্রত্যায়ন। এসব নথিপত্রে উভয়ের স্থায়ী ঠিকানা দেখানো হয়েছে, শাহপরীর দ্বীপ, বাজার পাড়া, সাবরাং টেকনাফ। তাদের দেয়া আবেদনের নথিতে অসঙ্গতি দেখা দেয়ায় আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন ফেনী সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসার আশ্রাফুল ইসলাম।
প্রাপ্ত নথিপত্র ও অনুসন্ধানে জানা যায়, ইব্রাহীম ও সাদিয়া দুজনই রোহিঙ্গা নাগরিক। ইব্রাহীমের পিতার নাম আবদুল কাদের ও মাতার নাম রহিমা। সাদিয়ার পিতার সিরাজুল হক ও মাতার নাম আয়েশা। রাখাইন থেকে আসার পর তারা প্রথমে পরিবারের সাথে কিছুদিন কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপে অবস্থান করেন। ২০১৫সালের ১৫নভেম্বর একটি পাসপোর্ট তৈরি করেন ইব্রাহীম। একই বছরের ৭সেপ্টেম্বর পাসপোর্ট তৈরি করেন সাদিয়া। সাদিয়ার মামা ফিরোজ আহমেদ এর সহযোগীতায় তারা উভয়ে সৌদি আরবে চলে যান। মামা ফিরোজের সাথে দুজনে গত ২৭জুন বাংলাদেশে আসেন। গত ২২জুলাই টেকনাফ সদরের কাজী রাগেবুল হকের অফিসে তাদের বিয়ে হয়। সৌদি আরবে চাকুরীর সুবাদে ফিরোজ আহমেদ এর সাথে সংখ্যতা গড়ে উঠে ফেনীর কালিদহ ইউনিয়নের যাত্রাসিদ্দি গ্রামের সৌদি প্রবাসি মোহাম্মদ পারভেজের। এই পারভেজের সহযোগীতায় যাত্রাসিদ্দি গ্রামের মাইন উদ্দিনের কাছ থেকে যাত্রাসিদ্দি বিএস ৮৭নং মৌজার বিএস ১৮৪নং দাগে দুই শতাংশ জমি ক্রয় করে ইব্রাহীম ও সাদিয়া।
সাদিয়ার মামা ফিরোজ আহমেদ বলেন, ইব্রাহীম ও সাদিয়া সৌদিতে কর্মরত আছেন। তারা শাহপরীর দ্বীপে পরিবার নিয়ে বসবাস করতো। এখন পরিবারের সাথে যোগাযোগ নেই। তাদের এদেশে একটি ঠিকানা ও পরিচয় প্রয়োজন। এজন্য আমি ইব্রাহীমের প্রবাসি বন্ধু সাখাওয়াত হোসেন পারভেজের সহযোগীতা কামনা করি। সে মেম্বার, চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন সরকারি অফিসারদের সহযোগীতায় দুটি এনআইডি কার্ড তৈরি করতে কাজ করেছেন। ফেনীর নির্বাচন অফিস বাতিল করায়, আমি কক্সবাজার থেকে গত ১৪আগস্ট পাসপোর্ট এবং ১১সেপ্টেম্বর আইডি কার্ড বানিয়ে দিয়েছি। তারা দুজনে এখন সৌদিতে আছে। তিনি আরো বলেন, এভাবে টাকা দিয়ে অনেকে করেছেন, টাকা দিলে সবই হয়।
প্রত্যায়ন দেয়ার ব্যপারে ফেনী সদরের ৬নং কালিদহ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন ডালিম বলেন, ৩নং ওয়ার্ডের যাত্রাসিদ্দি গ্রামের একটি দলিলের কপি ও ইউনিয়ন পরিষদের টেক্স আদায়ের রসিদ দেখিয়ে যাত্রাসিদ্দি গ্রামের প্রবাসী পারভেজ আমার কাছ থেকে দুটি প্রত্যায়নপত্র নেন। পরবর্তিতে এসব কাগজ দেখিয়ে এনআইডির আবেদনে ইউপি সদস্য নাসির উদ্দিন মিন্টুর সাক্ষর নেন ওই পারভেজ।
এ বিষয়ে সৌদি প্রবাসি সাখাওয়াত হোসেন পারভেজ জানান, সৌদির একটি মার্কেটে তার বাবার দোকানের পাশে ইব্রাহীম এর দোকান। সেই সুবাদে সংখ্যতা গড়ে উঠে। ইব্রাহীম স্ত্রী নিয়ে গত জুলাই মাসে তাদের বাড়ীতে এসেছিলেন। পারভেজের বাবা মাইন উদ্দিন খুশি হয়ে ইব্রাহীমকে দুই শতাংশ জমি দান করেছেন। সেখানে তারা ছোট একটা ঘর করেছে।
ফেনী সদর উপজেলা নির্বাচন অফিসার আশ্রাফুল ইসলাম বলেন, প্রবাসে থাকার অযুহাত দেখিয়ে ইব্রাহিম ও সাদিয়া গত ৩ জুলাই এনআইডির জন্য আবেদন করেছিলেন। আবেদনের সাথে জমা দেয়া নথিতে অসঙ্গতি দেখা দেয়ায় উভয়ের আবেদন খারিজ করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এমন অনেক আবেদন করা হয়। এসব অনিয়মে সহযোগীতা করে জনপ্রতিনিধি, ট্রাভেল এজেন্ট ও প্রভারশালীদের সংঘবদ্ধ চক্র। তাদের নেটওয়ার্ক দেশব্যাপি বিস্তৃত। তারা এক দপ্তরে ব্যর্থ হলে অন্য দপ্তরে চেষ্টা করেন। পরে জানতে পেরেছি ওরা দুজনই কক্সবাজার থেকে এনআইডি তৈরি করে নিয়েছে।