যারা ঘুষ নেন তারা সাধারণত রাখঢাক করেই নেন। কেউ অফিসের বাইরে নেন, কেউ অফিসে নিলেও টেবিলের তলা দিয়ে নেন; মোটকথা তারা লুকিয়েচুরিয়ে নেন। ঘুষের টাকার প্রমাণ তারা রাখতে চান না। এ ক্ষেত্রে পুরো ব্যতিক্রম মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি), খুলনা অঞ্চলের অফিস সহকারী আনোয়ারুল ইসলাম। আনোয়ার হোসেন নামেই পরিচিত, যিনি ঘুষের টাকার অঙ্ক কষে হিসাব রাখেন। এজন্য অফিসে একটি খাতা রেখেছেন।
প্রতিবেদকের হাতে আনোয়ারুল ইসলামের ঘুষের হিসাবের খাতার কয়েকটি পৃষ্ঠার ছবি আছে। তাতে দেখা যায়, তিনি একটি পৃষ্ঠায় তিনটি কলাম করেছেন। প্রথম কলামে নাম ও পদবি, দ্বিতীয় কল
জানা যায়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের সারা দেশে ৯টি আঞ্চলিক অফিস রয়েছে। এ অফিসগুলো থেকে সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিও, পদোন্নতি, গ্রেড পরিবর্তন, পেনশন, বহিঃছুটি প্রভৃতির কাজ করা হয়। খুলনা কার্যালয়ে খুলনা অঞ্চলের শিক্ষকদের সব কাজ করা হয়।
ঘুষের খাতার একটি পৃষ্ঠায় আনোয়ারুল লিখেছেন,‘কবির আলম গভঃ ল্যাবরেটরি হাইস্কুল-১০০০ টাকা, মো. ইদ্রিস আহমেদ নড়াইল সরকারি উচ্চবিদ্যালয়-২০০০ টাকা, নিজামউদ্দীন শহীদ আলী আহম্মদ (বালিকা বিদ্যালয়)-১৫০০ টাকা, স্বপ্না রাণী দাস যশোর জিলা স্কুল-১০০০ টাকা, মোমেনা অফিস সহায়ক ইকবালনগর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়-১০০০ টাকা, মো. নুরুল হক বাগেরহাট ল্যাম্পগ্রান্ড-২০০০ টাকা, হাসিনা খাতুন অফিস সহায়ক শহীদ আলী আহম্মদ বালিকা বিদ্যালয়- পেনশন-১০০০ টাকা। এভাবে অসংখ্য হিসাব লেখা রয়েছে।
সূত্র জানায়, মো. আনোয়ারুল ইসলাম অফিস সহায়ক হিসেবে ২০০৪ সালে খুলনা অঞ্চলে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। ২০১৪ সালে অফিস সহকারী পদে পদোন্নতি পান। ২০২০ সালের অক্টোবরে হিসাবরক্ষক পদে পদোন্নতি পেয়ে খুলনার দাকোপ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক অফিসে পদায়ন পান। মাত্র চার মাস সেখানে থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অফিস সহকারী পদেই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা, খুলনা অঞ্চল অফিসে ফিরে আসেন। অর্থাৎ তিনি খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ে থাকার জন্য পদোন্নতি পেয়েও নিম্নপদে চাকরি করছেন। ১৯ বছর ধরে একই কার্যালয়ে চাকরি করছেন। অথচ মাউশি অধিদপ্তরের নিয়মানুযায়ী, তিন বছর পরপর বদলি এবং বেতন বহাল রেখেও নিম্নপদ বা ভিন্নপদে চাকরি করার সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে মাউশি অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) বিপুল বিশ্বাস বলেন, ‘বর্তমান ডিজি স্যারের সময়ে স্ববেতনে বা ভিন্নপদে কাউকে পদায়ন করা হয়নি। আগে হয়ে থাকলে হতে পারে। যদি কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়, তাহলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খুলনার অফিস সহকারী আনোয়ারুল ইসলামের এমপিও এবং বদলি বাণিজ্য ওপেনসিক্রেট। স্বেচ্ছাচারিতা ও ঘুষবাণিজ্যে এতটাই বেসামাল সে, তাকে ঠেকানোর কেউ নেই। তিনি অফিসের সামনে একটি চা দোকান দিয়ে নিজের লোক বসিয়েছেন। কোনো লোক কোনো কাজে এলে ওই চা দোকান থেকে তার কাছে পাঠানো হয়। অফিসের অন্য কর্মচারীরাও কোনো কাজের জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের তার কাছে পাঠান। তিনি ঘুষ নিয়ে কাজ করেন।
সূত্র জানায়, খুলনার রূপসা উপজেলার শামসুর রহমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ফরিদা ইয়াসমিনের বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ে ৩০০ নম্বর না থাকায় আগে সাত-আটবার তার এমপিওর আবেদন বাতিল হয়েছে। গত নভেম্বরে আনোয়ারুল ইসলামের সহযোগিতায় তিনি এমপিওভুক্ত হয়েছেন। এজন্য যশোর শিক্ষা বোর্ডের এক কর্মকর্তার স্বাক্ষর জাল করে অতিরিক্ত শ্রেণি শাখা তৈরি করা হয়েছে। আনোয়ার ১২ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। খুলনা জুট মিলসের ৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে বাধ্যতামূলক পরিদর্শন প্রতিবেদন প্রণয়নে সুবিধা দেওয়ার জন্য আনোয়ার হোসেন বড় অঙ্কের ঘুষ নিয়েছেন। এ ছাড়া ছোটখাটো কাজে (যা তিনি খাতায় লিখে রাখেন) প্রতিদিন তার বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা আয় হয় বলে জানা গেছে।
শিক্ষকরা বলেন, সহকারী শিক্ষকদের পাসপোর্ট, বিদেশভ্রমণ, জিপিএফ ঋণ অনুমোদন, নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটি গঠনে অনৈতিক সুবিধা ছাড়া ফাইল ছাড়েন না আনোয়ার। পেনশন ল্যাম্পগ্রান্ডের মূল দায়িত্ব নাজমা খাতুনের হলেও এ কাজের জন্য আনোয়ার হোসেনের কাছে যেতে হয়।
অভিযোগ রয়েছে, আনোয়ারুল ইসলাম তার ভাই মো. আমিরুল ইসলামকে একটি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। আমিরুল ইসলাম ১৯৮৬ সালে জন্মগ্রহণ করলেও চাকরি নেওয়ার সময় তার জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মতারিখ জালিয়াতি করে ১৯৯২ সাল করা হয়েছে। তার এনআইডি নম্বর ৬৪৩৮৬২৬২৫৮ পরীক্ষা করলে এর প্রমাণ মিলবে। এ জালিয়াতি করেছেন আনোয়ারুল ইসলাম।
গত ফেব্রুয়ারিতে আরও কয়েকটি ঘটনায় আনোয়ারুল ইসলাম আলোচনায় আসেন। সাতক্ষীরার তালা ব্রজেন দে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী দিদার মোড়ল গাঁজার গাছসহ ধরা পড়ে জেল খাটেন। নিয়মানুযায়ী তার সাময়িক বহিষ্কার হওয়ার কথা। কিন্তু আনোয়ারুল ঘুষ নিয়ে দিদার মোড়লকে বাঁচিয়ে দেন। বাগেরহাট জেলা শিক্ষা অফিসের হিসাবরক্ষক কাম ক্লার্ক মো. আল মুরাদ ও অফিস সহকারী মো. শাহ আলম জমাদ্দার ঘুষের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে মারামারি করেন। রডের আঘাতে আল মুরাদ মারাত্মক জখমও হন।