
আন্তর্জাতিক ডেস্ক : অব্যাহতভাবে ইসরায়েলের বোমা হামলা ও জ্বালানি তেলের অভাবে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার ৩৫ হাসপাতালের মধ্যে ১২টিই বন্ধ হয়ে গেছে। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসাও দ্রুতই বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ।
তবে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম এরই মধ্যে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। যেসব হাসপাতাল কোনোমতে চালু রয়েছে, সেগুলোতে বিদ্যুৎ না থাকায় আইসিইউসহ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অনেক ব্যবস্থাই বন্ধ হয়ে গেছে।
ইসরায়েলি হামলার ১৮তম দিন ছিল গতকাল বুধবার। এ দিনও তারা আগ্রাসন চালিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৫৪৬-এ। হামলা আর জ্বালানির অভাবে হাসপাতালগুলোতে প্রায় সাত হাজার অসুস্থ ও আহত ফিলিস্তিনি মৃত্যুর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। খবর আলজাজিরা ও বিবিসির।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ড. আশরাফ আল-কুদরা বুধবার জানান, গাজার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এটি পুরোপুরি বন্ধের পথে। কারণ হিসেবে বোমা হামলা, কর্মী ও চিকিৎসাসামগ্রী না থাকার কথা জানান তিনি। এ সময় তিনি ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য জরুরি হস্তক্ষেপ চান বিশ্ব সম্প্রদায়ের। বেশ ক’দিন ধরে সতর্ক করে এলেও স্বাস্থ্যসেবা বন্ধের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমলে নেয়নি বলেও অভিযোগ করেন তিনি। হাসপাতালগুলোতে বাস্তুচ্যুতরাও আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
এদিকে জাতিসংঘ বলেছে, গাজার হাসপাতালের ৩০ শতাংশের বেশি বন্ধ হয়ে গেছে। সংস্থাটি জানায়, ৩৫টি হাসপাতালের মধ্যে ১২টি এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ৭২টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মধ্যে ৪৬টি বন্ধ হয়ে গেছে হামলা ও জ্বালানি সংকটে।
জাতিসংঘ জানায়, প্রায় ছয় লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি শরাণার্থী ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। এত সংখ্যক মানুষ বাড়িঘর হারিয়েছে যে ১৫০টি আশ্রয়কেন্দ্রে ধারণক্ষমতার চার গুণ মানুষ আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
শিশু নিহত বেড়ে ২ হাজার ৭০৪-
বুধবারও গাজার বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। তারা বাসাবাড়ি, মসজিদ-গির্জা, এমনকি শরণার্থী ক্যাম্পের বেসামরিক লোকজনের ওপরও হামলা চালায়। আল-সাথি ক্যাম্প ও আল-মাঘাজি ক্যাম্পে হামলায় কয়েক ডজন শরণার্থী মারা গেছেন। আহত হয়েছেন অনেকে। এসব ক্যাম্পে শত শত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। অন্যদিকে দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে একটি খামারে হামলায় ছয়জনকে হত্যা করা হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৭০৪ শিশুর প্রাণ গেছে। আহত হয়েছে ১৭ হাজার ৪৩৯ জন।
এদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াই অব্যাহত রেখেছে হিজবুল্লাহ। লেবাননের সশস্ত্র সংগঠনটি জানায়, ২৪ ঘণ্টায় ১১ জনসহ গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাদের ৪০ জন যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। ক্রমেই হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্ভাব্য যুদ্ধের শঙ্কা বাড়ছে। হিজবুল্লাহর শীর্ষ কর্মকর্তারা গাজায় পরিকল্পিত স্থল আক্রমণের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। ইসরায়েল বলেছে, গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে ধ্বংস করতেই স্থল আক্রমণ চালানো হবে।
বক্তব্য বিকৃত করার দাবি জাতিসংঘ মহাসচিবের-
এদিকে, ইসরায়েলের কড়া সমালোচনার জেরে জাতিসংঘ মহাসচিবের পদত্যাগে ইসরায়েলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আন্তোনিও গুতেরেস বুধবার বলেছেন, তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘ইসরায়েলে হামাসের নজিরবিহীন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের’ নিন্দা করেছেন। এর আগের দিন তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো কিছুই ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক লোকদের হত্যা, আহত এবং অপহরণ বা বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রকেট নিক্ষেপকে সমর্থন করতে পারে না। ইসরায়েলে হামাসের হামলা এমনি এমনি হয়নি। তারা ৫৬ বছর ধরে দখলদারিত্বের মধ্যে রয়েছে বলেও উল্লেখ করেছিলেন তিনি। তিনি ফিলিস্তিনি জনগণের কথা বলেছিলেন উল্লেখ করে তাঁর কথা বিকৃত করা হয়েছে বলেও দাবি করেন।
হামলা চলছে সিরিয়া-লেবানন সীমান্তেও-
হামলা হয়েছে সিরিয়ায়ও। দেশটির রাষ্ট্রীয় টিভি আলেপ্পো বিমানবন্দরে হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। খবরে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর লক্ষ্য করে বিমান হামলা হয়েছে। এতে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় মিডিয়া জানায়, অধিকৃত গোলান হাইটস থেকে রাতে ইসরায়েল আরেকটি হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত আট সেনা নিহত হয়। অন্যদিকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, মঙ্গলবার ইসরায়েলের দিকে উৎক্ষেপণের জবাবে সিরীয় সেনাবাহিনীর সামরিক অবকাঠামো এবং মর্টারগুলোতে হামলা চালিয়েছে তাদের বাহিনী।
ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধ পর্যায়ক্রমে অন্য দেশেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে উদ্বিগ্ন কাতার ও তুরস্ক। এ অঞ্চলে বিশেষ করে ফিলিস্তিনি সমস্যাগুলোর মধ্যস্থতার ক্ষেত্রে এ দুই দেশের বিশাল সুযোগ রয়েছে। হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে আঙ্কারা ও দোহার। তারা মূল ভূমিকা পালন করে আসছে। বন্দিদের মুক্তির আলোচনায় কাতার বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। দোহাও একটি ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়ে আসতে চাইছে।
এদিকে হামাসকে অস্ত্র, নগদ অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা দেওয়ার জন্য ইরানকে আবারও অভিযুক্ত করেছে ইসরায়েল। দেশটির সামরিক মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি এক ব্রিফিংয়ে বলেন, সর্বশেষ গাজা যুদ্ধের আগে হামাসকে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, অর্থ সরবরাহ এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞান দিয়ে সরাসরি সহায়তা করেছে ইরান। এখনও ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তথ্য এবং অনলাইন উস্কানি আকারে হামাসকে ইরানের সাহায্য অব্যাহত রয়েছে।
মস্কোতে ফিলিস্তিন দূতাবাসে আরব নেতারা-
আরব ও মুসলিম রাষ্ট্রদূতরা গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতার নিন্দা জানিয়েছেন। এসব দেশের রাষ্ট্রদূতরা রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে গিয়ে দেশটির সঙ্গে সংহতি প্রদর্শন করেন। এতে আরব লিগ, সিরিয়া ও বাহরাইনের রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। এ সময় তারা সব নৃশংসতার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেন।
এদিকে ভারত ফিলিস্তিনের জন্য ৩৮ টন ত্রাণ পাঠিয়েছে। তবে ইসরায়েলের পক্ষে পোস্ট দেওয়ায় সমাজে শত্রুতা ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে দুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তারা হলেন উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের হামিরপুর জেলার মুসলিম পণ্ডিত আতিফ চৌধুরী ও সুহেল আনসারি। তাদের অপরাধ, হোয়াটসঅ্যাপে তারা ‘আমি ফিলিস্তিনের সঙ্গে আছি’ এটি লিখেছেন। পুলিশ জানায়, আনসারিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর চৌধুরী পলাতক।