
রাজিব রায়হান, জাবি প্রতিনিধি:
হিমালয়ের উত্তরের দেশ সুদূর সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া ও নেপালে এ সময়ে প্রচুর তুষারপাত হয়। এজন্য পাখিরা বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে। শীতের শুরুতে আসে এবং শীতের শেষে তারা আবার চলে যায়।
তাই প্রতিবছরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোতে শীতের শুরুতেই দেখা মেলে অতিথি পাখির। বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়গুলোকে নিরাপদ মনে করে পাখিরা অবতারণ করে। এ সময়ে ক্যাম্পাসের জলাশয়ে বালিহাঁস, লেঞ্জা, জলপিপি, সরালি, পাতারি, চখাচখি, খঞ্জনা, চীনা, পান্তামুখী, পাতি হাঁস, পানিমুরগি, নর্থগিরিয়া, কমনচিল, কটনচিল, পাতিবাটান, পান্তামুখী, বুটি হাঁস বৈকাল, নীলশীর ও আরও নাম না জানা ২০৫ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এদের মধ্যে রয়েছে ১২৬ প্রজাতির দেশীয় পাখি।
এবার যেন ঘটছে ভিন্নরূপ। যেই ক্যাম্পাসে অতিথি পাখির কল-কাকলিতে ঘুম ভাঙ্গে শিক্ষার্থীদের আর সেখানে ডিসেম্বর মাসের শেষ প্রান্তেও দেখা নেই অতিথি পাখির। যেখানে শীতের শুরুতেই ক্যাম্পাসে ছোট-বড় ১২-১৫টি জলাশয় অতিথি পাখিতে পরিপূর্ণ থাকে কিন্তু এবার জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হল সংলগ্ন লেক, সুইমিং পুল সংলগ্ন লেকের মধ্যে পাখিদের ছোটাছোটি, ডুব সাঁতার বা এক পায়ের উপর চুপ মেরে বসে থাকা যেন চোখে পড়ছে না। তবে বোটানিক্যাল গার্ডেনের পাশে ওয়াইল্ডলাইফ রেসকিউ সেন্টারের লেকে কিছু অতিথি পাখির দেখা মিলেছে।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৫০ তম আবর্তনের শিক্ষার্থী তাহরিমা মেহের মিশু বলেন, “প্রতিবছরই এ সময়টাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি পাখির আগমন বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণ করে। তবে এ বছর আর সেই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না।শুধুমাত্র দুই একটি লেকে কিছু অতিথি পাখি দেখা যাচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে উঁচু ভবন নির্মাণ এবং ক্যাম্পাসে শব্দ দূষণ ও লেকগুলার পানি দূষিত হয়ে পড়ায় এমনটা হতে পারে।”
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান বলেন, “প্রতিবছরই অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় থাকে শুরু হয় অতিথি পাখি আগমন এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে এ পাখির সংখ্যা ও প্রজাতি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এ বছরে তা হয়নি। এর অন্যতম কারণ মনে করা হচ্ছে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত দর্শনার্থীদের আগমন, প্রচুর কোলাহল এবং মোটর চালিত যানের শব্দ দূষণ।
তিনি বলেন, যখন অতিথি পাখিরা লেকগুলোতে বসবে তখন অবশ্যই দেখবে লেকগুলো পরিবেশ তাদের জন্য কতটা নিরাপদ। এবার ওয়াইল্ডলাইভ রিসোর্স সেন্টারে কিছু পাখি এসেছে সেটাও বিগত বছরের তুলনায় সংখ্যা ও প্রজাতির দিক দিয়ে কম। তবে এভাবে চলতে থাকলে ক্যাম্পাস কয়েক বছরের মধ্যে অতিথি পাখি শূন্য হয়ে পড়বে।”
পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিন বলেন, “অতিথি পাখির আগমন ও অবস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত। বাংলাদেশের যেসব জায়গা গুলোতে অতিথি পাখির বিচরণ দেখা যায় তার মধ্যে জাবি খুবই পরিচিত। তবে এবারে অন্যান্য বছরে তুলনায় মাত্র একটি দুটি লেকেই দেখা মিলেছে এ পাখির। অতিরিক্ত দর্শনার্থীর আগমন, যানবাহনের চলাচল, ফেস্টিভ্যাল গুলোতে উচ্চস্বরে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও স্থাপনা নির্মান অতিথি পাখির ‘ফ্লাই জোন’ এর উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
তিনি আরও বলেন, শুধু এখানেই শেষ নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোর পানির গুণগত মান পরিবর্তন হয়েছে এবং ক্যাম্পাসের আশেপাশে ফসলি জমি কমে গেছে। ফলে অতিথি পাখিদের খাদ্যাভাব সৃষ্টি হয়েছে। এর জন্য বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনও কম দায়ী নয়। তাই জাহাঙ্গীরনগরে অতিথি পাখির ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে হলে অবিলম্বে অতিথি পাখির আবাসস্থল ও বিচরণ স্থানগুলো পরিকল্পনার মাধ্যমে সংরক্ষণ করতে হবে।”
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। তবে সম্প্রতি বছরগুলোতে ক্যাম্পাসের লেকগুলো অতিথি পাখিদের থাকার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তবে এখনই পাখিদের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত না করা গেলে অতিথি পাখির এমন বিচরণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।