
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের ঘনিষ্ঠ মিত্র। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক গত কয়েক বছরে আরও শক্তিশালী হয়েছে। তবে দেশ দুটির একসঙ্গে চলা সবসময় নির্বিঘ্নে ঘটেনি। দেশ দুটির সম্পর্কে প্রায়ই বিভিন্ন ইস্যুতে টানাপোড়েন দেখা যায়।
সর্বশেষ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে নতুন করে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। আগামী ১৯ এপ্রিল ভারতে জাতীয় নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে। এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির এই টানাপোড়েন।
দুর্নীতির অভিযোগে গত ২২ মার্চ ভারতের আম আদমি পার্টির (এএপি/আপ) প্রধান অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়। কেজরি সমর্থকদের অভিযোগ, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আম আদমি পার্টিকে বিপাকে ফেলতেই তাকে অন্যায়ভাবে আটক করেছে বিজেপি। এই ঘটনায় বুধবার (২৭ মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারসহ ভারতে বিভিন্ন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
মিলার বলেন, “উভয় ক্ষেত্রেই আমরা একটি ন্যায্য, স্বচ্ছ, সময়ানুবর্তী আইনি প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করি। আমরা মনে করি না যে, এতে কারও আপত্তি করা উচিৎ।”
এর আগে গত ২৫ মার্চ মিলার একই রকম মন্তব্য করেছিলেন। সেদিন মিলার বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারের প্রতিবেদন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং এ ব্যাপারে একটি ন্যায্য আইনি প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে।
মিলারের ওই মন্তব্যের পরদিনই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। পরদিন দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের উপ-প্রধান গ্লোরিয়া বারবেনাকে তলব করে ক্ষোভ জানানো হয়।
গ্লোরিয়াকে তলবের পরদিনই মিলার বিষয়টি নিয়ে ফের মন্তব্য করেন। মিলার বলেন, “আমরা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারসহ ভারতে বিরোধী দলগুলোর বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর ওপর নিবিড়ভাবে নজর রাখছি। আমরা কংগ্রেস পার্টির অভিযোগ সম্পর্কেও অবগত যে, ভারতের কর কর্তৃপক্ষ তাদের কিছু ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এমনভাবে জব্দ করেছে, যা দলটির জন্য আসন্ন নির্বাচনে কার্যকরভাবে প্রচার চালানোকে চ্যালেঞ্জিং করে তুলবে। আমরা এই প্রতিটি সমস্যার জন্য ন্যায্য, স্বচ্ছ এবং সময়ানুবর্তী আইনি প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করি।”
এর জবাবে বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) নতুন করে একটি বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানায় নয়া দিল্লি। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বৃহস্পতিবার ওই বিবৃতিতে বলেন, “বিরোধী দলীয় নেতাদের গ্রেপ্তার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো অযৌক্তিক। ভারতে আইনি প্রক্রিয়াগুলো আইনের শাসন মেনেই পরিচালিত হয়। যাদের একই রকম নীতি আছে, বিশেষত যারা আমাদের মতোই গণতান্ত্রিক দেশ, তাদের এই সত্যটি উপলব্ধি করতে কোনও অসুবিধা হওয়া উচিৎ নয়।”
যুক্তরাষ্ট্রের মন্তব্যগুলো ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের প্রশাসন ভালোভাবে নেয়নি। নয়া দিল্লির কূটনীতিকরা মন্তব্যগুলোকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ হিসেবেই দেখছে। এতে দিল্লির কূটনৈতিক পাড়ায় বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, “ভারতের আইনি প্রক্রিয়াগুলো একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়, যা নৈর্ব্যক্তিক এবং সময়োপযোগী ফলাফলের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এর উপর কোনও আপত্তি তুলে ধরা অযৌক্তিক।”
তিনি আরও বলেন, “কূটনীতিতে রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে বলেই আশা করা হয়। এই দায়িত্ব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে আরও বেশি। অন্যথায় অস্বাস্থ্যকর নজির স্থাপিত হতে পারে।”
কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগে জার্মানিও উদ্বেগ জানায়। গত সপ্তাহে জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছিল, তারা আশা করেন- ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ায় কেজরিওয়াল ন্যায্য ও নিরপেক্ষ বিচার পাবেন।
ভারত সেই মন্তব্যেরও তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় এবং ক্ষোভ জানাতে একজন জার্মান কূটনীতিককে তলব করে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের বিভিন্ন বিরোধী দলীয় নেতারা বিজেপির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের শীর্ষ তদন্ত সংস্থাগুলোকে বিরোধী দলগুলোকে পঙ্গু করার এবং নির্বাচনের আগে ভিন্নমতকে দমনের জন্য ব্যবহারের অভিযোগ করেছেন।
কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তারের কয়েক ঘণ্টা আগে ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টিও এক সংবাদ সম্মেলনে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। কংগ্রেসের অভিযোগ, জাতীয় নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রের কর বিভাগকে দিয়ে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করা হয়েছে।
এর আগে জানুয়ারিতে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার কয়েক ঘণ্টা পরে শীর্ষ বিরোধী নেতা হেমন্ত সোরেনকেও দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। সোরেন ও তার দল কোনও অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত থাকার দায় অস্বীকার করেছে এবং বিজেপির বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ করেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও বলেছে, ভারতে শান্তিপূর্ণ ভিন্নমত ও বিরোধীদের ওপর ক্র্যাকডাউন এখন সংকটজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
যাই হোক, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের টানাপোড়েন এবারই প্রথম নয়। এর আগেও ভারতের বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের মন্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় দিল্লি। ভারতীয় কূটনীতিকরা এসবকে ভারতের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অযাচিত হস্তক্ষেপ হিসেবেই আখ্যা দেয়। তথ্যসূত্র: ফার্স্ট পোস্ট, বিবিসি, এনডিটিভি, ওয়ান ইন্ডিয়া, দ্য ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস।