পৃথিবীর অনিন্দ্যসুন্দর এবং আকর্ষণীয় দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হিমালয়কন্যাখ্যাত দেশ নেপাল। নেপাল এমন একটি দেশ যেখানে আপনি একসঙ্গে পাবেন আপনার ছুটি উপভোগের সবকিছু। মন্দির, স্বচ্ছ হ্রদ, সারি সারি সবুজ ভ্যালি, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র, পাহাড় কিংবা তাদের রাজপ্রাসাদ-সব কিছুতেই মুগ্ধতা! এ যেন পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় আরেকটা দেশ যোগ করার প্রবল ইচ্ছার কারণে হিমালয়কন্যা নেপাল ছিল পছন্দের একদম শীর্ষে। দেশ থেকে যাতায়াতের সুবিধা আর অন অ্যারাইভাল ভিসার কারণে ঠিক করলাম ঈদের ছুটিতে নেপাল গিয়ে ঘুরে আসি। যে কথা সেই কাজ, বন্ধুদের বলতেই রাজি হয়ে গেল। প্রথমে পাঁচজন যাওয়ার কথা থাকলেও পরে সেই সংখ্যাটা বেড়ে সাতজন হয়ে যায়।
পরে ফ্লাইটের টিকিট কাটা, ট্যুরের ডিটেইলস প্ল্যান করতে করতে যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত অনেক ইনফরমেশন গ্যাপে ছিলাম। জীবনের প্রথম একটা মাঝারি টাইপের ট্রেকে (মারদি হিমাল) যাওয়ার পরিকল্পনা আর একবারই নেপালের বেশখানিকটা অংশ কভার করে আসার ইচ্ছার কারণে কোন দিক ছেড়ে কোন দিকে যাব, সেটা নিয়েই অনেক কনফিউশনে ছিলাম।
প্রথমত, নেপাল খুবই ট্যুরিস্ট ফ্রেন্ডলি আর খুবই এক্সপেনসিভ একটা দেশ অন্তত ট্যুরিস্টদের জন্য। এটা মাথায় রেখেই খরচে আসা যাক। আমাদের ঘোরার দিন অনুযায়ী একটা প্ল্যান এখানে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
যাতায়াত : আপনার ছুটি কত দিনের তার ওপর ভিত্তি করে পরিকল্পনা সাজিয়ে নিন। আকাশ ও সড়কপথে নেপাল যাওয়া যায়। তবে আকাশপথে খরচ বেশি হবে আর সময় ও শারীরিক পরিশ্রমের মাত্রা বেশি হবে সড়কপথে। বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট ঢাকা থেকে কাঠমান্ডু এবং কাঠমান্ডু থেকে ঢাকা চলাচল করে প্রতিদিন।
ঢাকা থেকে ফ্লাইটে কাঠমান্ডু পৌঁছাতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টার মতো। বোর্ডিং কার্ড নেওয়ার সময় বাঁ দিকে আসন নেওয়ার চেষ্টা করবেন, তাহলে ল্যান্ডিংয়ের আগে একনজর হিমালয় দেখে নেওয়ার সুযোগ পাবেন। নেপালে শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখাই নয়, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের সুবিধাও রয়েছে।
সাত বা আট দিন সময় পেলে পোখারা ও তার আশপাশের এলাকাগুলোও ঘোরার সুযোগ পাবেন আপনি। যারা এভারেস্ট বা অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে ট্রেকিংয়ের কথা ভাবছেন, তাদের জন্য অবশ্য সম্পূর্ণ আলাদা পরিকল্পনা। বলে রাখি, সুন্দর আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য পূর্বপরিকল্পনা ভীষণ জরুরি।
কাঠমান্ডুর পর্যটন এলাকার নাম থামেল। এটি কাঠমান্ডুর পুরোনো এলাকার দিকে অবস্থিত। প্রতিটি গলিতে হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং কেনাকাটার প্রচুর দোকান আছে। বেশিরভাগ ভ্রমণকারী থামেলেই থাকেন। ইন্টারনেট ঘেঁটে দেশে বসেই দেখে নিতে পারেন আপনার বাজেট অনুসারে হোটেলগুলোর অবস্থা।
এ ছাড়া ওয়ো মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করেও খুঁজে নিতে পারেন আপনার পরিকল্পনামতো পছন্দের হোটেল। হোটেলগুলো আপনি প্রতিদিন বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে পাবেন। আর যারা অনেকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকতে চান বা ব্যাকপ্যাকার পরিবেশে থাকতে চান, তাদের জন্য আছে জোস্টেল (Zostel) নামের দারুণ হোটেল চেইন।
কাঠমান্ডু, পোখারা দুই শহরেই পাবেন জোস্টেলের সুবিধা। বুকিং করে নিতে হবে ওয়েবসাইট থেকে। এগুলোতে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বাঙ্ক বেড আর ২ হাজার টাকার মধ্যে পাবেন আলাদা কক্ষ। সুবিধা ও চাহিদা অনুসারে দামের হেরফের হতে পারে। তাই আগেভাগে বুকিং করা ভালো।
হোটেলের আশপাশেই পেয়ে যাবেন খাবার রেস্তোরাঁ। অনেক সময় রেস্তোরাঁগুলোতে যে খাবার দেয় তা দুজনে ভাগ করে খাওয়াও সম্ভব।প্রথম দিন বিকালের বাকি সময় কাটাতে পারেন থামেলের কাছে ‘গার্ডেন অব ড্রিমস’–এ ঘুরে। হেঁটে ঘুরতে পারেন পুরোনো কাঠমান্ডুর অলিগলি। দরবার স্কয়ারের দিকে সন্ধ্যাটা বেশ জমে উঠে নানা বয়সি মানুষের ভিড়ে। পুরোনো কাঠমান্ডু আর থামেলের আশপাশটা হেঁটে ঘোরাটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। সন্ধ্যায় থামেলের গলিগুলো জমে ওঠে পর্যটকদের পদচারণে।
ওপেন এয়ার রেস্তোরাঁর গানের আওয়াজ আর বাতাসে প্রেয়ার ফ্ল্যাগের আলোড়ন আপনাকে আমোদিত করবে। হালকা নাশতার জন্য রাস্তার পাশে ছোট ছোট খাবারের দোকানে পাবেন মোমো, বিভিন্ন কাঠি কাবাব আর চাওমিন। তবে রাত ১০টার দিক থেকে রাস্তাগুলো খালি হতে শুরু করে আর ক্লাবগুলো সরব হতে থাকে। এ সময় হেঁটে ঘোরাঘুরি করতে পারেন দলবেঁধে। নেপালে একদম ফিক্সড প্রাইজ সুপারশপ বাদে সব জায়গাতেই দামদর করে জিনিস কিনবেন।
চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্ক
দ্বিতীয় দিনটি রাখা উচিত কাঠমান্ডু ও তার আশপাশের ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্য। আর যদি তিন–চার দিনের ছোট ট্যুর হয়, তবে দিনটা শুরু করা উচিত নগরকোটে সূর্যোদয় দেখে। সাধারণত, যে হোটেলে থাকবেন, সেখান থেকে পরের দিনের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার সার্ভিস নিতে পারেন। প্রতিটি হোটেলের নিজস্ব গাড়ি বা পরিচিত এজেন্সি থাকে, যেগুলো এই কাজে নিয়োজিত।
আপনি সারা দিনের জন্য গাড়ি ভাড়া করে নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে খরচ পড়বে ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার বাংলাদেশি টাকায়। নগরকোটে সূর্যোদয় দেখতে চাইলে মাঝরাতে রওনা হতে হবে। এখানে আপনাকে ড্রাইভার বা গাইডের ওপর নির্ভর করতে হবে, যদি আপনি একেবারে নতুন হয়ে থাকেন। তারাই আপনাকে জানিয়ে দেবে সবকিছু। সূর্যোদয় দেখার জন্য আপনাকে খরচ করতে হবে বাড়তি দেড় থেকে দুই হাজার বাংলাদেশি টাকা।
নেপালে প্রথমবার হলে ড্রাইভার বা গাইডের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে পারেন আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে। আর নেপালে যাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলে গুগল ম্যাপ দেখে আপনার পরিকল্পনা ঠিক করে ড্রাইভার বা গাইডকে জানান। কাঠমান্ডু ও তার আশপাশের মূল দর্শনীয় স্থানগুলো হলো কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ার, শয়ম্ভুনাথ মন্দির, বৌদ্ধনাথ মন্দির, পশুপতিনাথ মন্দির এবং প্রাচীন ভক্তপুর শহর।
এর বাইরেও রয়েছে বহু মন্দির ও চক এবং স্কয়ার। কাঠমান্ডু এমন একটি শহর, যেখানে ইতিহাস মিশে রয়েছে প্রতিটি ইঞ্চিতে। যে জায়গাগুলো টিকিট কেটে দেখতে হয়, সেগুলোতে সার্কভুক্ত দেশের জন্য টিকিট মূল্য নামমাত্র। অনেক জায়গায় বাংলাদেশি হওয়ার কারণে আপনি বিনা টিকিটেই সেসব জায়গা দেখার সুযোগ পাবেন।
চার দিনের ভ্রমণ হলে ভক্তপুরকে পরের দিন দেখার জন্য রেখে দিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে শপিংয়ের জন্য কিছুটা সময় পাবেন হাতে। আর যদি আপনি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা চান, তবে প্রথম বা দ্বিতীয় দিন হোটেলে ফিরেই বুকিং করে ফেলুন ‘দ্য লাস্ট রিসোর্টে’ এক দিনের ট্রিপ। থামেলেই আছে এদের অফিস।
ভোর ছয়টায় ওদের শাটল বাসে করে রওনা হয়ে ঘণ্টা চারেকের মধ্যে পৌঁছে যাবেন রিসোর্টে। সেখানে আছে বাঞ্জি জাম্প, সুইং জাম্প, রিভার র্যাফটিংসহ নানা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ। কেউ রাতে থাকতে চাইলে ক্যাম্পিংয়ে সুযোগও আছে। বিভিন্ন প্যাকেজ থেকে আপনার নিজের পছন্দের প্যাকেজটি বেছে নিতে হবে।
কাঠমান্ডু থেকে পোখারা বাসে যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে। কাঠমান্ডুতে যে হোটেলে উঠবেন তাদের বললেই তারা আপনাকে সব ব্যবস্থা করে দেবে। অথবা আপনিও একটু খবর নিয়ে পোখারা যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলতে পারেন গুগলের সাহায্য নিয়ে। পোখারা যাওয়ার পথে রাস্তার পাশের খাবারের রেস্তোরাঁগুলোতে বাস থামবে। সেগুলোতে খাওয়া-দাওয়াসহ আপনার প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিতে হবে। পোখারার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে আছে ফেওয়া হ্রদ ও তার আশপাশের এলাকা, ওয়ার্ল্ড পিস প্যাগোডা, ডেভি’স ফলস, ভারাহি মন্দির ও বেশ কিছু জাদুঘর।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ঘুরে বাসযাত্রায় বেশ আনন্দ পাবেন। পোখারা শহর অনেক গোছানো। সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য মুগ্ধ করবে আপনাকে। পোখারা পৌঁছে সময় পেলে হোটেলে ব্যাগ বোঁচকা রেখে চলে যান লেকের ধারে। লেকের পাড়ে বসে, পাহাড়ের আড়ালে সূর্যাস্ত দেখা অসাধারণ স্মৃতি হিসেবে থাকবে আপনার আজীবন।
পোখারার মূল আকর্ষণ ফেওয়া হ্রদ এবং এর ওপর করা প্যারাগ্লাইডিং। পাহাড়ের ওপর থেকে ফেওয়া হ্রদের ওপর দিয়ে উড়ে বেড়ানোর সময় পুরো পোখারা উপত্যকা দেখতে পাবেন। এই হ্রদের পাশ দিয়ে যাওয়া সড়কের পাশে পাবেন পুরো ট্যুরিস্ট জোন এবং হোটেল ও দোকানপাট। মূল শহরটি এই লেক রোড থেকে বেরিয়ে ভেতরের দিকে।
পোখারার সারাংকোট থেকেও আপনি দেখতে পারেন হিমালয়ের কোলে সূর্যোদয়। ভোর হওয়ার আগে আপনাকে যেতে হবে সারাংকোট। মাচাপুচ্ছুরে পর্বতের গায়ে সূর্যোদয় দেখতে বহু মানুষ আসে এখানে। আগের মতোই এখানেও হোটেলে থাকা–খাওয়া এবং ঘোরাঘুরির সব ব্যবস্থা করতে পারবেন। হোটেলের জন্য এখানে খরচ পড়বে ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার বাংলাদেশি টাকা।
এখানে ভাড়া পাওয়া যায় বাইসাইকেল বা মোটরবাইক/স্কুটার। ভাড়া করা তাই বাইসাইকেল বা মোটরসাইকেল/স্কুটারে করে নিজের পছন্দমাফিক ঘুরতে বেশ মজা। আর না হলে সারা দিনের জন্য ট্যাক্সি ভাড়া করতে পারেন অথবা সাধারণ যানবাহন ব্যবহার করতে পারেন। বাইসাইকেলের ভাড়া সারা দিন ৫০০ টাকার মতো পড়বে। মোটরবাইক/স্কুটার নিতে পারবেন যদি আপনার বাংলাদেশি ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকে। লাইসেন্স না থাকলে পাসপোর্ট জমা রাখতে হতে পারে।
সন্ধ্যায় ক্যাফে আর পাবগুলো সরব হয়ে উঠে পোখারার লেক রোডে। বিভিন্ন জায়গায় এক কাপ কফির সঙ্গে খেলতে পারেন স্নুকার বা অন্য কোনো বোর্ড গেম। ঘুরে দেখতে পারেন বিভিন্ন দোকান, কেনাকাটার জন্য। পোখারায় বেশ কিছু নামকরা নেওয়ারি (নেপালি) খাবারের দোকান আছে। আর আছে কিছু নামকরা পিজ্জারিয়া বা পিৎজার দোকান। রাতের খাবার সারতে পারেন এগুলোতে।
পোখারাতে দর্শনীয় জায়গাগুলো হয়তো এক দিনেই দেখে ফেলা সম্ভব। তারপরও পরামর্শ থাকবে পোখারাতে এক দিন বেশি থাকার। শহর, হ্রদ মিলিয়ে অসাধারণ সুন্দর জায়গা পোখারা। আর হাতে টাকা থাকলে পোখারা থেকে মাউন্ট এভারেস্ট সাইট সিয়িং ফ্লাইটে উড়ে আসতে পারেন এভারেস্টের চূড়ার কাছ থেকে। খরচ পড়বে প্রতিজনের জন্য ২০০ ডলার বা ১৭ হাজার বাংলাদেশি টাকা।
পোখারা থেকে কাঠমান্ডু ফিরবেন বাসে করে। বিকাল ও সন্ধ্যাটা ঘুরেফিরে, কিছু শপিং করে চলে যাবে। পরদিন ফিরতি ফ্লাইট। একটু সময় নিয়ে চলে যান এয়ারপোর্টে। যথারীতি চেষ্টা করবেন বাঁ দিকে আসন নেওয়ার। তাহলে ফিরতি পথেও দেখা হয়ে যাবে হিমালয়।
খাবার খরচ : পোখারায় একটা হোটেলে মোটামুটি এটা ২৫০ নেপালি রুপিতে কভার করা যেত। কাঠমান্ডুতে আরেকটু বেশি লেগেছে। নেপালে সব জায়গায় চায়ের দাম ৩০ রুপি থেকে ৫০ রুপির মাঝে ওঠানামা করে। পাহাড়ের ওপর ৭০-১০০ হয়ে যায়। হোটেলে না থাকলে কেউ গরম পানি খেতে চাইলে এক্সট্রা ৫০ রুপি লাগে।
১ Comment
Very excellent info can be found on website.Blog range